পুড়ছে তেল-গ্যাস-কয়লা, আর ঝড়ের গতিতে নির্গত হচ্ছে কার্বন। নিদারুণ ক্ষতবিক্ষত জলবায়ু; টগবগ করে ফুটন্ত এ গ্রহ। কিন্তু এবারও জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দেশগুলোর বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিনিধিদের বিশাল বহর পুরো সম্মেলনকেই সন্দেহ ও তর্কের মরূদ্যানে ঠেলে দিয়েছে। ব্রাজিলের আমাজন জঙ্গলঘেঁষা বেলেম শহরে চলমান জলবায়ু সম্মেলনে (কপ৩০) প্রতি ২৫ অংশগ্রহণকারীর একজন জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির লবিস্ট।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেল, গ্যাস, কয়লা কিংবা রাসায়নিক বিষ কোম্পানির লবিস্টরা ‘বনোয়াট কুতর্ক’ আর ‘মিথ্যা সমাধান’-এর বিজ্ঞাপন দিয়ে পৃথিবীর বাঁচা-মরার প্রশ্নের সম্মেলনের গতিকে অযথাই নষ্ট করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর এ বড় উপস্থিতি বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনার জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য, যারা ইতোমধ্যেই জলবায়ু-সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থায়ন সংকটে ভুগছে।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনে রেকর্ডসংখ্যক জীবাশ্ম জ্বালানির লবিস্টের উপস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক জোট কিক বিগ পলিউটার্স আউট (কেবিপিও) জানাচ্ছে, এ বছর সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি খাতের এক হাজার ৬০০ জনের বেশি লবিস্ট অংশ নিয়েছেন। জাতিসংঘের যে কোনো জলবায়ু সম্মেলনে এ সংখ্যা রেকর্ড সর্বোচ্চ।
শুক্রবার প্রকাশিত কেবিপিওর বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়, কপ৩০-এ লবিস্টদের উপস্থিতি বিশ্বের প্রায় সব দেশের সরকারি প্রতিনিধি দলের চেয়ে বেশি। শুধু ব্যতিক্রম আয়োজক ব্রাজিল, যাদের প্রতিনিধি সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৮০৫ জনে। তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, বেলেমের সম্মেলন ভবনে প্রতি ২৫ অংশগ্রহণকারীর একজনই লবিস্ট। গত বছরের আজারবাইজানের কপ২৯-এর তুলনায় তাদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশ।
কেপিবিওর মুখপাত্র অনা সানচেজ বলেন, এটি কোনো কপে এখন পর্যন্ত রেকর্ড সর্বোচ্চ জীবাশ্ম জ্বালানির লবিস্টের উপস্থিতি। এটি প্রমাণ করে, যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান জলবায়ু সংকটের জন্য দায়ী, তারা এখনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে, যা মূলত তাদের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাসের জন্য হওয়া উচিত।
জোটের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শীর্ষ ১০টি সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশের প্রতিনিধিদের তুলনায় জীবাশ্ম জ্বালানির লবিস্টরা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বেশি পাস পেয়েছেন, যা সংখ্যায় এক হাজার ৬১ জন। ফিলিপাইনের সরকারি প্রতিনিধিদের তুলনায় জীবাশ্ম জ্বালানির লবিস্টদের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বেশি। জ্যামাইকার তুলনায় ৪০ গুণ বেশি। অথচ এগুলো জলবায়ু ঝুঁকির শীর্ষে থাকা দেশ। এ পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে, জলবায়ুর ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়ের কণ্ঠকে করপোরেট স্বার্থ দমন করছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক এমিশনস ট্রেডিং অ্যাসোসিয়েশন ৬০ জন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে কপ৩০-এ। যার মধ্যে রয়েছেন এক্সনমবিল, বিপি ও টোটাল ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রতিনিধি। গ্লোবাল নর্থের কিছু দেশও তাদের সরকারি প্রতিনিধি দলে জীবাশ্ম জ্বালানি-সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। যেমন ফ্রান্সের ২২ সদস্যের প্রতিনিধি দলে পাঁচজন টোটালের প্রতিনিধি, জাপানের প্রতিনিধি দলে ৩৩ জন লবিস্ট, নরওয়ের ১৭ সদস্যের মধ্যে ছয়জন ইকুইনরের কর্মকর্তা।
সরকারি প্রতিনিধি দলের বাইরেও প্রায় ৫৯৯ জন লবি পার্টি ওভারফ্লো ব্যাজের মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছে। কেবিপিওর সদস্য সংগঠনগুলো বলছে, এই প্রবেশাধিকার কপ৩০-এর বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ব্রাজিল যদিও এবারের সম্মেলনকে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন ও জলবায়ু তহবিল জোরদারের মোড় বদল হিসেবে দেখাতে চাচ্ছে। কিন্তু করপোরেট উপস্থিতি সেই লক্ষ্য পূরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ফিলিপাইনের আইবন ইন্টারন্যাশনালের জ্যাক্স বোনবন বলেন, ৩০ বছরের ৩০টি কপ পার হওয়ার পরও দেড় হাজারের বেশি লবিস্ট স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটি প্রমাণ করে তাদের প্রভাব কতটা গভীর। ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়কে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের সুবিধামতো একই মিথ্যা ‘সমাধান’ চাপিয়ে দিচ্ছে।
কপ৩০ হলো প্রথম সম্মেলন, যেখানে বেসরকারি অংশগ্রহণকারীরা তাদের অর্থায়নের উৎস প্রকাশ ও ইউএনএফসিসিসির লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করতে বাধ্য। তবু কেবিপিওর গবেষণায় দেখা গেছে, ১৬৪ জন লবিস্ট সরকারি প্রতিনিধি পরিচয়ে প্রবেশ করেছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, সারাবিশ্বে ২০২৫ সাল রেকর্ড উষ্ণতার বছর হিসেবে সামনে আসতে পারে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের ঘনত্ব এখন বড় উচ্চতায়। কপ২৯-এর পর থেকে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার নতুন তেল-গ্যাস প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
জেন্ডার কনস্টিটুয়েন্সির কো-ফোকাল পয়েন্ট প্যাট বোহল্যান্ড বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির লবি শুধু নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করছে না, বরং মাটি, নদী, মানুষ এবং নারীদের শরীর পর্যন্ত শোষণের চক্রকে টিকিয়ে রাখছে। আলোচনাকে তেল কোম্পানির লবিস্ট মুক্ত না করলে পরিবর্তন সম্ভব হবে না।
বিশ্বের নাগরিক সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী সতর্ক করেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি লবির আধিপত্য ঝুঁকিপূর্ণ দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর জন্য হুমকি। বিশেষ করে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, লবণাক্ততা আর তীব্র তাপদাহের মধ্যে নির্গমন-নির্ভর উন্নয়ন মডেল আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কেবিপিওর সদস্য রজনিতা গুপ্তা বলেন, কপ মানুষের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা হওয়া উচিত। কিন্তু করপোরেট প্রভাব সেই নীতিকেই নস্যাৎ করছে।
কপ৩০-কে ‘বাস্তবায়নের সম্মেলন’ হিসেবে দেখা হলেও লবিস্টদের রেকর্ড উপস্থিতি সম্মেলনের লক্ষ্য আর বিশ্বাসযোগ্যতাকে বড় প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো তাই এটিকে এক ধরনের সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখছে।
জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন ও বিতর্কিত ন্যায্য রূপান্তর (জাস্ট ট্রানজিশন) ইস্যুতে তীব্র মতবিরোধে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কপ৩০-এর আলোচনা। গত তিন দিনে কিছু অগ্রগতি মিললেও উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অবস্থানের ফারাক পুরো দরকষাকষিকে চেপে ধরে। এ টানাপোড়েনের মধ্যে বাংলাদেশ আবারও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়– গ্লোবাল জলবায়ু কূটনীতিতে সমতা ও ন্যায়বিচার প্রশ্নে তার অবস্থান বদলায়নি। দেশের প্রতিনিধি দলের প্রধান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ফারিদা আখতার বলেন, বাংলাদেশ ন্যায়সংগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু পদক্ষেপে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত।
পরিবেশ অধিদপ্তরের আন্তর্জাতিক সনদবিষয়ক পরিচালক মির্জা শওকত আলী জানান, বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ অভিযোজন অর্থায়ন তিন গুণ বৃদ্ধির দাবি তুলছে এবং ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার জন্য নতুন তহবিলকে দ্রুত কার্যকর দেখতে চায়।
সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, অভিযোজন অর্থায়নের বাস্তব চাহিদা কখনোই পূরণ হয়নি। তাঁর মন্তব্য, কপ২৯ বছরে ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার জোগানের প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্তই নেয়নি। ৩০০ বিলিয়ন ডলারের সিদ্ধান্তও রোডম্যাপ না থাকলে অপূর্ণই থেকে যাবে।
বাংলাদেশি যুব প্রতিনিধি ও ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়কারী সোহানুর রহমান বলেন, অভিযোজন অর্থায়ন দয়া নয়, এটা বেঁচে থাকার প্রশ্ন।
জলবায়ু পরিবর্তনের বাড়তি প্রভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশ বড় আর্থিক চাপে পড়েছে। স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ অভিযোজন সহায়তা প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে তার তুলনায় অতি সামান্য অর্থায়ন মিলছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) কপ৩০-এর হেলথ ডে উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য মো. জিয়াউল হক। রিজিওন৪, গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ অ্যালায়েন্স ও কার্বন কপির আয়োজন করা ‘অভিযোজন অর্থায়নের কেন্দ্রে স্বাস্থ্য’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে জিয়াউল হক জানান, বাংলাদেশের হেলথ ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান বাস্তব সমস্যা শনাক্ত করা ও সীমিত সম্পদের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্য খাতের অভিযোজন অর্থায়ন এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। আমাদের চাহিদা আর প্রাপ্ত সহায়তার মধ্যে ব্যবধান বিশাল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রতিশ্রুত অর্থ দ্রুত ছাড়ের অনুরোধ জানান তিনি।
ল্যানসেট কাউন্টডাউনের নির্বাহী পরিচালক ড. মারিনা রোমানেল্লো জানান, প্রতি বছর তীব্র গরমে বিশ্বে পাঁচ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। দাবানলের ধোঁয়ায় মারা যান আরও দেড় লাখ। বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ইতোমধ্যে চাপে; ভবিষ্যতের ঝুঁকি সামলানোর মতো প্রস্তুত নয়। মাত্র ৪৪ শতাংশ দেশ স্বাস্থ্য অভিযোজনের আর্থিক চাহিদা নিরূপণ করতে পেরেছে। ফলে বৈশ্বিক ঘাটতি আরও বাড়ছে।
কপ৩০-এ আফ্রিকার বিশেষ দূত কার্লোস লোপেস বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের ঘাটতি বিশাল। বেশির ভাগ উদ্যোগই দেশগুলো নিজ অর্থে চালাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা পরিপূরক হওয়া উচিত এবং তা অনেক বাড়াতে হবে।
ভারতের প্রতিনিধি ড. বিশ্বাস চিতালে জানান, জলবায়ু প্রভাব মোকাবিলায় ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটির ৬৪৩ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। আর নাইজেরিয়ার প্রতিনিধি ওডেন ইওয়া জানান, ২০২১-২২ সালে স্বাস্থ্য খাতের অভিযোজন চাহিদার মাত্র ৬ শতাংশ অর্থায়ন সম্ভব হয়েছে, যদিও তাপদাহ ও ভারী বর্ষণে রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যান্ড হেলথ অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক জেনি মিলার বলেন, জলবায়ু অভিযোজনে স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্ব এখন এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে মাত্র।
আমারবাঙলা/এফএইচ