পামেলা অ্যান্ডারসন অভিনেত্রী হিসেবে ১০টির বেশি পুরস্কারে মনোনয়ন পেয়েছেন; নব্বইয়ের দশকের পামেলাকে চিনলে আপনি চমকে যেতে পারেন। প্লেবয় সাময়িকীর প্রচ্ছদের নগ্ন কন্যা হিসেবে যাঁর পরিচিতি, তিনি অভিনেত্রী হিসেবে গোল্ডেন গ্লোব বা সেগ পুরস্কারে মনোনয়ন পাবেন, কে ভেবেছিল। ‘দ্য লাস্ট শো গার্ল’ দিয়ে চমকে দেওয়া পামেলা আবার ফিরছেন বড় পর্দায়। আজ মুক্তি পেয়েছে তাঁর নতুন সিনেমা ‘দ্য নেকেড গান’। সিনেমাটি মুক্তি উপলক্ষে আলো ফেলা যাক পামেলার জীবন আর ক্যারিয়ারে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের কথা। একটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে হঠাৎ করেই দুনিয়াজোড়া আলোচনায় এলেন এক কানাডীয় তরুণী। স্বর্ণকেশী চুল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর অপ্রতিরোধ্য আত্মবিশ্বাসের নাম—পামেলা অ্যান্ডারসন। পরবর্তী কয়েক বছরে তিনি হয়ে উঠলেন পপ–সংস্কৃতির প্রতীক, প্লেবয় ম্যাগাজিনের সবচেয়ে বেশি প্রচ্ছদ হওয়া মডেল আর অতি অবশ্যই ‘বেওয়াচ’ সিরিজের সেই লাল সাঁতারের পোশাক পরা সমুদ্রকন্যা—যাঁকে কেউই ভুলতে পারে না।
নব্বইয়ের দশকে টেলিভিশনের পর্দা কাঁপানো সেই পামেলা অ্যান্ডারসন তিন দশকের বেশি সময় পর আজ আবারও আলোচনায় সিনেমা দিয়ে। কানাডার ছোট্ট শহর থেকে প্লেবয়ের প্রচ্ছদ, চুরি হওয়া সেক্স টেপ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ আর বিতর্ক মিলিয়ে পামেলার জীবন যেন রঙিন এক সিনেমা। কিন্তু সেই গ্ল্যামারের আড়ালে আছে তীব্র যন্ত্রণা, অসমাপ্ত লড়াই আর এক নারীর হার না মানার গল্প।
শৈশবে দুঃস্বপ্নের দিন
পামেলার জন্ম কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার লেডিসমিথ শহরে, সবুজে মোড়া এক দ্বীপে। ছোটবেলায় মাটির কেক বানানো, সাপ ধাওয়া করা আর বুনো আপেলের গাছ ঘিরে ঘোরাঘুরিতে কেটেছে দিন। কিন্তু প্রকৃতির এত সৌন্দর্যের মধ্যেও তাঁর শৈশব ছিল ‘অভিশপ্ত’।
মায়ের ওপর বাবার শারীরিক নির্যাতন তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। সে সময়কে স্মরণ করে পামেলা বলেন, ‘আশপাশে সব সুন্দর ছিল, কিন্তু ঘরের ভেতর ছিল শব্দ আর ভয়।’
নিজেও শিশু বয়সে একাধিকবার যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মাত্র ছয় বছর বয়সে এক নারী বেবিসিটার তাঁকে নিয়মিত শারীরিকভাবে নির্যাতন করতেন। এরপর ১২ বছর বয়সে ২৫ বছর বয়সী এক পরিচিত ব্যক্তি তাঁকে ধর্ষণ করেন। আর ১৪ বছর বয়সে প্রেমিক ও তাঁর বন্ধুরা মিলে যৌন নির্যাতন চালান পামেলার ওপর। ‘আমি কাউকে কিছু বলিনি। শুধু ভুলে যেতে চেয়েছি,’ পামেলা তাঁর আত্মজীবনী ‘লাভ, পামেলা’-তে এভাবেই লিখেছেন সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা।
জীবন বদলে যাওয়া সেই ম্যাচ
পামেলার জীবন বদলে যায় এক ফুটবল ম্যাচে গিয়ে। ২২ বছর বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার এক স্টেডিয়ামে বসে থাকা অবস্থায় স্টেডিয়ামের জাম্বো স্ক্রিনে তাঁর ছবি ভেসে ওঠে, এক বিয়ার কোম্পানির লোগোসহ টি-শার্ট পরে। সেই ছবি দেখে কোম্পানি তাঁকে তাদের মুখপাত্র বানায়। এরপরই ডাক আসে প্লেবয়ের কাছ থেকে।
সেই প্রথম ফটোশুটেই তিনি বুঝতে পারেন, নারীত্বকে নিজের মতো করে অনুভব করার মানে কী। ‘আমার যৌনতা তখন আমার নিজের ছিল,’ বলেন পামেলা। প্লেবয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রচ্ছদ হওয়া মডেল তিনি। প্লেবয়ের প্রতিষ্ঠাতা হিউ হেফনার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তিনিই একমাত্র মানুষ, যিনি আমাকে পুরোপুরি সম্মান করেছিলেন।’
প্লেবয়ের প্রচ্ছদে প্রথম ছবি ছাপা হওয়ার পরই যেন বদলে যায় পামেলার জীবন। তিনি হয়ে ওঠেন পুরুষদের আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, তবে একই সঙ্গে শুরু হয় গণমাধ্যমের অবিরাম নজরদারি, পারিবারিক জীবনের জটিলতা আর আত্মপরিচয়ের সংকট।
‘খুব অল্প বয়সেই আমি এত বিশাল পরিচিতি পেয়েছি যে সেটা হজম করাটাই হয়ে ওঠে কঠিন। কেউ কখনো জানতে চায়নি আমি কে, আমি কী ভাবি, আমি কী করতে চাই। শুধু আমাকে দেখতে চেয়েছে,’ বলেন পামেলা।
টমি লি, ‘বেওয়াচ’ ও ভিডিও চুরি
‘বেওয়াচ’ তাঁকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করে তোলে। কিন্তু খ্যাতির সেই পথেই ছিল এক ভয়ংকর বাঁক। ১৯৯৫ সালে টমি লিকে বিয়ের মাত্র চার দিনের মধ্যেই কানকুনের সৈকতে বিয়ে সারেন পামেলা। কিন্তু এ সম্পর্ক খুব বেশি দিন টেকেনি।
দম্পতির ঘর থেকে চুরি হওয়া ভিডিওতে ছিল তাঁদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত; দ্রুতই অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম বছরেই তা ৭৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি হয়। এ ঘটনায় তাঁদের সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। পামেলা লিখেছেন, ‘এটা আমাদের সম্পর্ক ধ্বংস করে দেয়। আজও কেউ কেউ এই কাণ্ড থেকে মুনাফা করে যাচ্ছে, এটা ভয়ংকর।’
পরে এক মারধরের ঘটনায় টমি লির ছয় মাসের জেল হয়। কারণ, তিনি পামেলাকে লাথি মেরেছিলেন, যখন তিনি তাঁদের সাত সপ্তাহ বয়সী সন্তান ডিলানকে কোলে নিয়ে ছিলেন।
একের পর এক বিয়ে, তবু অসম্পূর্ণ প্রেম
পামেলা মোট ছয়বার বিয়ে করেছেন, পাঁচজন পুরুষকে। তাঁর মতে, প্রেমিক বাছাইয়ে তিনি ভুল করতেন—প্রথম দিকে তাঁর প্রেমিকেরা ছিলেন আক্রমণাত্মক ও খামখেয়ালি। তবু ভালোবাসার খোঁজ কখনো ছেড়ে দেননি। তাঁর ভাষায়, টমি লি-ই হয়তো একমাত্র ব্যক্তি, যাঁকে তিনি সত্যিকারের ভালোবেসেছিলেন।
পামেলা এখন সময় কাটান লেডিসমিথে, তাঁর দাদির পুরোনো বাড়িতে, তিনটি কুকুরের সঙ্গে। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ভেগান, পশু অধিকার ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সোচ্চার। পেটার মুখপাত্র হিসেবেই তিনি একবার রাশিয়ার ক্রেমলিনে যান।
সেখানে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁকে সরাসরি না দেখলেও বারবার খোঁজ রেখেছিলেন। পামেলার ভাষায়, ‘তিনি আমার কথা শুনতেন আর আমাকে নিয়ে একটু মজা পেতেন।’
পামেলা ঘনিষ্ঠভাবে দেখা করেছেন উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের সঙ্গেও। তাঁদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতাম, মেজকাল খেতাম আর হাসতাম,’ বলেন পামেলা।
মা হিসেবে অপরাধবোধ
পামেলার দুই ছেলেই বড় হয়েছেন মিডিয়ার নজরদারির মধ্যে। পামেলা বলেন, ‘আমি সব সময় চেয়েছি ওদের একটা স্বাভাবিক জীবন দিই। কিন্তু আমি জানতাম না কীভাবে দিতে হয়। মিডিয়া আমাদের ঘিরেই থাকত। ওরা আমার খ্যাতির মূল্য দিচ্ছিল, অথচ আমি তো শুধু একটা কাজ করেছিলাম।’
এ কারণে মাঝেমধ্যে নিজেকে দোষী মনে করেন পামেলা। তবে তাঁর ছেলেরা এখন যখন বড় হয়েছেন, তখন তাঁরা মায়ের গল্পটা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন—একজন মানুষ হিসেবে, একজন মা হিসেবে, একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে।
নিজের গল্প
২০২৩ সালে মুক্তি পায় তাঁর আত্মজীবনী ‘লাভ, পামেলা’। একই সময়ে নেটফ্লিক্সে আসে তাঁকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ‘পামেলা: আ লাভ স্টোরি’। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি সেই চুরি হওয়া টেপটা ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম, বাঁচার জন্য। এখন আবার যখন সেটা সামনে এসেছে, আমি অসুস্থ বোধ করি।’
তবে প্লাস্টিক সার্জারি, গ্ল্যামার, আলোচিত প্রেম—সবকিছু এক পাশে সরিয়ে রেখে এখন পামেলা খুঁজে পেয়েছেন নতুন এক শান্তি। এখনকার পামেলা মেকআপবিহীন চেহারায় ক্যামেরার সামনে আসেন, আত্মজীবনী লেখেন, পরিবেশ রক্ষা নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখনই সবচেয়ে বেশি নিজেকে চিনতে পারছি। আমি সুন্দর হতে চাই না, আমি সত্যিকারের হতে চাই।’
নতুন পামেলা
দুই বছর আগেও পামেলা ভাবতেন, তাঁর সময় বুঝি ফুরিয়েছে। তাই নিজেকে গুটিয়ে নেন কানাডার ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ডে, লেডিসমিথে সমুদ্রতীরবর্তী নিজ বাড়িতে। সিদ্ধান্ত নেন—বাগান আর পশুপাখিই হবে তাঁর পৃথিবী। বিতর্ক, খ্যাতি, সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন অনেক বছর। কিন্তু তখন আর তেমন কাজের প্রস্তাব আসছিল না।
শেষ বিচ্ছেদ হয়েছিল দেহরক্ষী ড্যান হেয়ার্স্টের সঙ্গে। এরপর ফিরে যান নিজ শহরে। ‘আমি বাড়ি ফিরে গাছপালা করতাম, আচার আর জ্যাম বানাতাম, একটা ভেগান কুকবুক লিখেছিলাম, এমনকি একটা ভেগান কুকিং শো-ও করেছিলাম। আমি সেসবে পুরোপুরি খুশি ছিলাম,’ বলছিলেন পামেলা। পাল্টে যাওয়ার শুরুটা ২০২২ সালে, যখন এক নাটকে রক্সি হার্ট চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান। ‘আমি জানতাম না আমি নাচতে পারি, আমি গান গাইতে পারি—কোনোটাই না,’ বলছিলেন পামেলা।
কিন্তু পামেলার জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেয় ‘দ্য লাস্ট শোগার্ল’ সিনেমা। পরিচালক জিয়া কপোলা (ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার নাতনি) মাত্র ১৮ দিনে ছবির শুটিং করেন ১৬ মিমি ফিল্মে। সিনেমাটি ভেগাসের পুরোনো গ্ল্যামারঘেরা শোগার্ল সংস্কৃতির শেষ দিনের গল্প, যেখানে পামেলা অভিনয় করেছেন ‘শেলি’ চরিত্রে। এই শেলি মূলত নর্তকী; যিনি এখনো পুরোনো ধ্যানধারণায় বিশ্বাস করেন।
‘এটাই প্রথমবার, যখন একটা চরিত্র দেখে মনে হলো, এটা আমি করতে পারব,’ বলেন পামেলা। শেলির মানবিক চরিত্রে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। বিশেষ করে শেলির একটি মেয়ে আছে, যেটি পামেলার নিজের মা হওয়ার অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে গেছে। ‘এই ইন্ডাস্ট্রিতে সন্তান প্রতিপালন সহজ নয়,’ বলেন পামেলা।
সিনেমাটির পটভূমিতে রয়েছে গভীর সামাজিক প্রতিচ্ছবিও। বয়স বাড়লে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, কাম্য নারীর রূপ কি কেবল যৌবনে সীমাবদ্ধ, না পরিণত বয়সেও সে পূর্ণতা পেতে পারে? এমন প্রশ্ন তুলেছেন নির্মাতা।
‘দ্য নেকেড গান’
পামেলার কণ্ঠে এখন স্পষ্ট অভিনয়ের প্রতি শ্রদ্ধা। তিনি বারবার পড়েন ‘অ্যাক্টিং: দ্য ফার্স্ট সিক্স লেসন’ বইটি। পড়া শেষ করেই আবার শুরু করেন। ‘আমি একটা স্পঞ্জের মতো। জানতেই চাই, আমার ভেতরে আসলে কী আছে,’ বলেন তিনি। লিয়াম নিসনের সঙ্গে আজ মুক্তি পেয়েছে পামেলা অভিনীত নতুন সিনেমা ‘দ্য নেকেড গান’। এটি ‘দ্য নেকেড গান’ ফ্র্যাঞ্চাইজির চতুর্থ সিনেমা। সিনেমাটিতে পামেলার চরিত্রটি ফেম ফেটাল ধরনের। এ ছাড়া আরও অভিনয় করেছেন নতুন দুই সিনেমায়। পামেলার বয়স এখন ৫৮, তিনি যেকোনো চরিত্রে অভিনয় করতে চান।
‘আমি যেন নিজেকে নতুন করে ফিরে পেয়েছি। ভেবেছিলাম, রুপালি পর্দার ক্যারিয়ার শেষ কিন্তু “দ্য লাস্ট গার্ল” আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। নতুন নতুন চরিত্র, প্রিমিয়ার, সাক্ষাৎকার আর সব শেষে নিজের বাড়িতে ফিরে প্রিয় কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া—সব উপভোগ করছি।’
আমারবাঙলা/জিজি