বিভেদ বিভাজন বৈষম্যের বেড়াজাল

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ:

সেই স্বর্গবাসের কাল থেকে বিভেদ-বিভাজন চলে আসছে। আদি চাচারা, হাবিল-কাবিল বিভাজন মতেনৈক্যের ফেরে পড়ে প্রথম খুনোখুনির শিকার হয়েছিলেন। আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞা ও শ্রদ্ধা জানাই। হিসাব কষে বের করা যাবে এই শতসহস্র আত্মত্যাগের অন্যতম প্রেরণা ছিল নিজেরাই নিজেদের শত্রুতায় সৃষ্ট বিভেদ-বিভাজন-বৈষম্য থেকে মুক্তি।

তুলনার জন্য বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। মাত্র ২৬৭ বছর আগে এই ভারতবর্ষে সিপাহসালারের বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতিতে ইংরেজদের এ দেশে আগমন এবং এদেশীয়দের মধ্যে বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টি করে বৈষম্য-বঞ্চনার বেড়াজালে আটকিয়ে ১৯০ বছর এবং পাকিস্তানী সংসার মাত্র ২৪ বছর টিকেছিল। বিভেদ-বিভাজন-বৈষম্য সৃষ্টিকারী এখন নিজেদের ঘরেও তার প্রেরণা ও প্রযোজনা পাশের বাড়ি থেকে।

১৯৪৫ সালে লন্ডনে বসেই চার্চিল সাহেব ভারত বর্ষেও স্বাধীনতা দেওয়ার নামে যেভাবে ভারত ভাগের চাল চেলেছিলেন তা ছিল ঐক্যবদ্ধ ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করা; তার অন্যতম কূটকৌশল ছিল ভারতের প্রধান দুই সমৃদ্ধ অঞ্চল বাংলা ও পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করে দুই পরম শত্রুর সংসারে গুছিয়ে দেয়া। ফলশ্রুতিতে ভয়াবহতম মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষ। আজো আঞ্চলিক অর্থনীতি ও সমৃদ্ধি সাধনের পথে অন্তরায় হিসেবে আছে এই বিভেদ-বিভাজন মানসিকতা। মি. জিন্নার টু নেশন থিওরিকে সমালোচনা তারাই করেন যারা ওয়ান ইন্ডিয়া হবার বিরোধিতায় ছিলেন, সেটা ছিল এক ধরনের ভণ্ডামি। টু নেশন থিওরির সমালোচকরাই সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধনদাতা হয়েও তারাই ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র বুলি আউড়ান, অভিনয় করেন।

ভারত তথা বাংলা ভাগের সময় নিছক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভেদবুদ্ধিতে কোলকাতাকে পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতের ভাগে রাখতে যারা বদ্ধ পরিকর ছিলেন তারাই পূর্ববঙ্গকে ‘পঙ্গু ,ব্যর্থ ও অকার্যকর’ করতে পূর্ববঙ্গেও চট্টগ্রামকে দাবি করে বসে। ১৩ আগস্ট (১৯৪৭) সর্দার প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনের কাছে ‘চট্টগ্রাম ভারতের চাই, পাকিস্তানকে এটা দেয়া হবে চরম অন্যায়’ বলে যখন আলটিমেটাম দেন তখন মাউন্টব্যাটেন র‌্যাডক্লিফ এর বাটোয়ারা ম্যাপ (রোয়েদাদ) জারি পেছানোর পথ ধরেন। ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৭ আগস্ট র‌্যাডক্লিফ এর বাটোয়রা ম্যাপ জারির দিন সাব্যস্ত হয়। মাউন্ট ব্যাটেন তার ডায়রিতে লিখেছেন, ‘আগে আমি করাচি ও দিল্লির ক্ষমতা হস্তান্তর কাজ নির্বিঘ্নে শেষ করি তারপর ১৭ তারিখ এটি জারি করলে দাঙ্গা ও হাঙ্গামা থেকে আগাম রেহাই মিলবে।’ হলোও তাই। এই প্রেক্ষাপটে এখনো চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিতে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট যারা কায়েম করতে চাইছে তারা এখনো তাদের ভারতের ওপর দিয়ে ভূটান ও নেপালের সাথে ট্রানজিট দিতে গড়িমসি অব্যাহত রয়েছে।

আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গা ও তিস্তার পানিতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা দিতে নানান কূটকৌশলের ক্যারিসমায় উজানে পানি সরিয়ে নিয়ে গঙ্গা ও তিস্তায় পানি প্রবাহ কমে যায়। ফলে ভাটির দেশে নদী ও নিসর্গ, অন্যতম অবলম্বন কৃষি অর্থনীতির অব্যাহত ক্ষতি সাধনসহ প্রাকৃতিক সুরক্ষা সুন্দরবনকে ধ্বংসের স্লো পয়জনিং চলছে। তিস্তার উৎসমুখ ও মধ্য পর্যায়ে পানি সরিয়ে তিস্তাকে পানি শূন্য করে এখন শোনানো হচ্ছে ‘পানি নেই তো দেব কোত্থেকে? এ ক্ষেত্রে ভূরাজনীতির ভায়রা ভাইদের মধ্যে ঠাণ্ডা যুদ্ধের শিকার হচ্ছে ভাটির দেশ বাংলাদেশ। এমনকি একই দেশের কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে তর্ক-তর্কি ও অভিনয়ে বাংলাদেশকে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে , পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বাংলাদেশ (সকলে মিলে সেই বৃহৎ বাংলা) এর মধ্যকার বিভেদ-বিভাজন বজায় রাখতে পারলে স্বস্তি মিলবে কেন্দ্রের এবং সূদুর প্রসারী সেই পরিকল্পনা তারা যেন বন্ধুত্বে এক না হতে পারে তার পথ পরিষ্কার করা ।

প্রতিবেশী রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের কানেকটিভিটির মন্ত্র পড়িয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ৭ রাজ্যে যাওয়ার পথ ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের সাথে ৭ রাজ্যের কানেকটিভিটির সম্ভাবনা ও সুযোগকে গলা টিপে হত্যা করা এবং এমনকি সেখানকার স্বাধীনতার স্বপ্নকে দমন করা। আস্তে আস্তে এটাও স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, মাতারবাড়ী ও সোনাদিয়ায় জাপানি সহায়তায় গড়ে তোলা জাপানের বিগ বি বিশাল অবকাঠামোর সুযোগ সম্প্রসারিত করা হবে সেই সাত রাজ্যেও। এখানেও এক ঢিলে দুই পাখি শিকারের সাফল্যের স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক নদী পানির হিস্যা দিতে গড়িমসি করলেও বাংলাদেশ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজস্ব ফেনী নদীর পানি দেয়ায় সমতার ভিত্তিতে সহ-অবস্থানের অধিকার নিয়ে নেগোশিয়েশন নীতি কৌশলের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। এসবই সেই সনাতন বিভেদ-বিভাজন মানসিকতার ফলশ্রুতিতে।

ভূরাজনীতির বিভাজন ক্রীড়াকৌশল এখন দেশ অভ্যন্তরেও দূরারোগ্য ব্যধির মতো গেড়ে বসেছে। দগদগে ঘা যেমন তেমনি ৫৩ বছর বয়েসি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির শিরোনামে বিভক্ত করা হয়েছে। সেই ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যকার দেয়াল উধাও, দ্বিধা-বিভক্ত প্রশাসন, জনসেবা, বিচার বিভাগ সবই। বাংলাদেশের প্রশাসন দলীয়করণ গ্রেশাম সিনড্রম-এর কবলে পড়েছে বলে প্রয়াত আকবর আলী খান একটা আলাদা বইই লিখেছেন। পিএসসিতে সর্বোচ্চ পদে নিয়োগের সুপারিশ পেয়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রার্থী নিয়োগই পায়না অদৃশ্য কারণে। কোটা আন্দোলণে শিক্ষার্থীদের দু-দুবার নামতে হয়েছে, অসংখ্য তরুণের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। মেধার অবমূল্যায়নের দ্বারা প্রকারান্তরে দেশ ও জাতিকে মেধা শূন্য করার, বৈষম্যের বিরোধী কণ্ঠরোধ, মানবাধিকার লংঘনের এমন উগ্র বাসনা কেন ও কার স্বার্থে? কার স্বার্থে চাকরিতে ওএসডি কালচারের নামে প্রশাসনের মেধাবি ও করিৎকর্মাদের সরিয়ে, হাজার হাজার কর্মকর্তাদের বসিয়ে বেতন দিয়ে পাবলিক মানির ক্ষতি সাধনসহ প্রশিক্ষিত মানব সম্পদকে অকর্মন্য করে অপচয় এবং তদস্থলে দলীয় অদক্ষ প্রার্থীদের রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদে নিয়োগের পাঁয়তারা সাম্প্রতিককালে কোটা আন্দোলন, বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনে রুপ নেয়ায় এ বিষয়টি সামনে চলে আসে। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত, অন্যের ভেদ বুদ্ধি, প্ররোচনা ও প্রযোজনায় নিজের নাক কেটে (নিজের ভবিষ্যত মানব সম্পদ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস করে) হলেও নিজ দেশে বিভেদ-বিভাজন ও বৈষম্যের শিকার জনগণের কণ্ঠরোধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও কোনঠাসা এমনকি গুম (আয়না ঘরে আটকিয়ে) হত্যার তৎপরতাই ছিল ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’র একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাঠ-ঘাট পয়মাল করতেই এই বিভেদ-বিভাজন বৈষম্য ও নির্যাতন এর শিকার হয় ‘বাংলাদেশের জনগণ’, মহান মুক্তিযুদ্ধে যাদের ত্যাগ স্বীকারের স্বীকৃতি রয়েছে সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রারম্ভে। এই বিভেদ ও বিভাজনের, বৈষম্যের বেড়াজালে আটকানোর চেষ্টা চলে, রাজনীতি-দুর্বৃত্তায়ন-দলীয়করণের দ্বারা বিভেদ সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ-বিচার বিভাগ, সংসদ বা আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে, এমনকি চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়ার মধ্যেও। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের দ্বারা তারা সহজে সরকারের বশংবদ বাহকে পরিণত হয়- নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে ও প্রয়োজনে।

বিভেদ বিভাজন বৈষম্যের বেড়াজাল এটির প্রেরণা চানক্যের অর্থশাস্ত্র, জওহরলাল নেহেরুর ডকট্রিনেরও।

একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ ও জাতির অগ্রগতি থামিয়ে দেয়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রকৃষ্ট কৌশল হচ্ছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বেপথে (ডিরেইলড) করে দেয়া। পাবলিক মানি খরচ করে শিশু-কিশোরদের বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাদের মুক্তবৃদ্ধি চর্চার, ইতিহাস সচেতনতা এবং মস্তিক্য প্রক্ষালনের প্রথমেই সুযোগ নেয়া, দলকানা ও চেতনার ধ্বজাধারি লেখকদের রাজনৈতিক উৎকোচ দেয়া আর মুদ্রণ ও সরবরাহ কাজে দুর্নীতি দুষ্কর্ম তো আছেই। দেশে দক্ষ জনবল না গড়ে বিদেশীদের এখানে নিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা, দেশের বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ পয়মল করে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বানের অভিনয় করা এবং বেসরকারি শিল্প খাতকে অচল করে, শিক্ষিত তরুণদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি না করে, তাদেরকে বেকার রেখে দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগ করার গভীর ষড়যন্ত্রের কবলে বাংলাদেশের আর্থিক খাত, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। দেশ থেকে উদ্যোক্তারাও পাচার হচ্ছেন এবং বিদেশে শিক্ষিতরা দেশে ফিরতে উৎসাহ হারাচ্ছেন। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ন্যয়নীতি বোধ তিরোহিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যে নবজাগরণ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে , তাতে অর্থখাত , শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় স্বনির্ভর হওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি, বিভেদ-বিভাজেনের বেড়াজাল, যা সমতাভিত্তিক সমাজ ও সহজাত সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য, ব্যবধান বেড়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য সর্বত্র, সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে তারা রাষ্ট্র ও সরকার সামলানোর ভূমিকায় অবতীর্ণ। রাষ্ট্রাচারে বিধিবিধান অনুসরণ যেহেতু দায়িত্ব ও কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে সেহেতু এ ব্যাপারে রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয় পক্ষেরই পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র নাগরিকের মানবিক মৌলিক অধিকার ও সেবার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সৃষ্ট জটিলতা, অসম্পূর্ণতা, জবাবদিহিহীনতার পুরো পরিবেশটাকে ঢেলে সাজাতে প্রথমেই নির্বাচন ব্যবস্থাকে সৎ, স্বচ্ছ ও সাবলীল হওয়ার প্রসঙ্গ চলে আসবে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গঠিত সরকার নির্বাচিত হবে জনগণের দ্বারা এবং তারা পরিচালিত হবে জনগণের জন্য। রাষ্ট্রকে কর রাজস্ব প্রদান এড়িয়ে চলার বা ফাঁকি দিয়ে পার পাওয়ার প্রতিরোধাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ, করের টাকায় কেনা অস্ত্রের গুলিতে করদাতা কিংবা তার সন্তান হত্যা বন্ধ করা এবং করের টাকা দুর্নীতি দুবৃত্তপরায়নের দ্বারা লোপাট না হতে দেয়া, জবাবদিহীতার পরিবেশে নাগরিকের সকল মৌলিক অধিকার ও দাবি পূরণে রাষ্ট্রের স্বচছতাসুলভ আচরণ ও সেবা প্রাপ্তি সুনিশ্চিত হলেই বিভেদ-বিভাজন বৈষম্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তি মিলবে।

ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন। সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড

সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম

আমার বাঙলা/আরএ