ছবি: সংগৃহীত
মতামত

শিক্ষাই পারে জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপ দিতে

মোঃ শামীম মিয়া

‘জনসংখ্যা’—এই একটি শব্দেই যেমন লুকিয়ে আছে একটি জাতির শক্তি, তেমনি এর ভেতরেই রয়েছে সম্ভাব্য সংকটের ছায়া। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, অধিক জনসংখ্যা বরাবরই একটি জটিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। উন্নত হোক বা অনুন্নত—সব দেশই কোনো না কোনোভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে, এখনো করছে।

তবে প্রশ্ন হলো—এই ‘সমস্যা’ আদৌ কি কেবলই সমস্যা? নাকি যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটিই হয়ে উঠতে পারে এক অমিত সম্ভাবনার দ্বার? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াসেই এই আলোচনা।

জনসংখ্যা: সম্ভাবনা না সংকট?

বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ে গবেষণা, তর্ক ও বিতর্ক বহুদিনের পুরোনো। আসলে কেবল জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিজে কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা তখনই হয়, যখন সেই জনসংখ্যা প্রতিপালনে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যর্থ হয়, মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যাঘাত ঘটে, কর্মসংস্থান সংকট তৈরি হয় এবং জীবনমান নিচে নেমে যায়।

১৮শ শতকের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থমাস রবার্ট ম্যালথাস তাঁর ‘জনসংখ্যা তত্ত্ব’-এ বলেন, খাদ্য ও সম্পদের উৎপাদন বাড়ে গাণিতিক হারে (১, ২, ৩, ৪...), আর জনসংখ্যা বাড়ে জ্যামিতিক হারে (১, ২, ৪, ৮...)। ফলে একসময় জনসংখ্যা উৎপাদন ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে যায়, এবং দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য ও বিশৃঙ্খলা।

ম্যালথাসের এই তত্ত্ব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—যদি জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উৎপাদন ও সামাজিক সেবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলে, তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে বোঝায় পরিণত হয়।

তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে—তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের এই যুগে কি আমরা ম্যালথাসের সেই পূর্বাভাসকে রুখে দিতে পারি না?

শিক্ষা: সম্ভাবনার দ্বার

জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তরের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে, দক্ষ করে তোলে এবং শ্রমবাজারে প্রবেশের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। একজন শিক্ষিত মানুষ তাঁর চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের পাশাপাশি সমাজ ও দেশকে উপকৃত করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজন জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তবমুখী শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষা, প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞান ও কর্মমুখী প্রশিক্ষণ একজন মানুষকে আত্মনির্ভর করে তোলে।

যেমন—একজন কৃষক আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির জ্ঞান থাকলে তাঁর উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়তে পারে। একজন গ্রামীণ নারী যদি সেলাই বা হস্তশিল্পে দক্ষতা অর্জন করেন, তিনিও হয়ে উঠতে পারেন উপার্জনক্ষম। আবার একজন তরুণ যদি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন বা অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রশিক্ষিত হন, তবে তিনি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে পারেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা

বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তরুণ জনগোষ্ঠীনির্ভর রাষ্ট্র। দেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা ২৫ বছরের নিচে। এই বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠী যেমন একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তেমনি সঠিকভাবে পরিচালিত হলে হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রধান চালিকাশক্তি।

জাতিসংঘের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২২ কোটিতে পৌঁছাবে। এখন যদি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করা যায়, তবে এই জনসংখ্যাই হয়ে উঠবে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর অন্যতম সম্ভাব্য উৎস।

শিক্ষার অভাব মানেই বেকার জনগোষ্ঠী

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কারণ, অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো তত্ত্বনির্ভর পাঠ্যক্রমে আটকে আছে। ফলে গ্র্যাজুয়েশন শেষে শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের চাহিদা পূরণে অক্ষম হয়ে পড়ে।

এই ব্যবধান দূর করতে পাঠ্যক্রমে বাস্তবমুখী পরিবর্তন আনতে হবে। সফট স্কিল, যোগাযোগ দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও উদ্যোক্তা মানসিকতা—এসবকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই সৃজনশীলতা, শ্রমের মর্যাদা ও মূল্যবোধ শেখাতে হবে।

নারীশিক্ষা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ

নারীশিক্ষা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষিত নারীরা অধিক সন্তান না নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা মেনে চলেন। ফলে জন্মহার কমে এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হয় প্রাকৃতিকভাবে।

শিক্ষিত নারীরা কর্মজীবনে প্রবেশে আগ্রহী হন, যা দেশের অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক। তাই নারীশিক্ষার প্রসার ঘটানো শুধু প্রয়োজনই নয়, জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তরের পথে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

দক্ষতা ও কর্মসংস্থান

শুধু সার্টিফিকেট নয়, প্রয়োজন দক্ষতা। প্রতি বছর কয়েক লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করে; কিন্তু দক্ষতার অভাবে তারা অনেকেই চাকরি পান না। এ জন্য কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বিস্তৃত করতে হবে।

প্রতিটি উপজেলায় প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুললে তরুণ-তরুণীরা হাতে-কলমে কাজ শেখার সুযোগ পাবে, যা তাদের আত্মনির্ভর করে তুলবে।

শিক্ষাই রূপান্তরের প্যানাসিয়া

‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’—এটি নিছক একটি স্লোগান নয়, বরং একটি বাস্তব দর্শন। জনসংখ্যা তখনই সম্পদে রূপান্তরিত হয়, যখন তারা সুশিক্ষিত, দক্ষ ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়।

তাই বাংলাদেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া, এবং জনশক্তিকে মানবসম্পদে রূপান্তরের রূপরেখা তৈরি করা।

এই রূপান্তর শুধু জনসংখ্যার চাপই কমাবে না, বরং দারিদ্র্য, দুর্নীতি, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ও বেকারত্বের মতো সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধেও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, কারিগরি জ্ঞান এবং নারীশিক্ষার প্রসার—এই চারটি স্তম্ভকে ভিত্তি করে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে এক মানবসম্পদনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে।

জনসংখ্যা আর কোনো ভয় নয়—যদি আমরা বিনিয়োগ করি শিক্ষায়, দক্ষতায় এবং সম্ভাবনায়।

শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে এই জনসংখ্যাই একদিন হবে জাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি।

মোঃ শামীম মিয়া
প্রাবন্ধিক ও শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ

আমারবাঙলা/এফএইচ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

রসুন ক্ষেতে মুরগি যাওয়াকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ায় চাচাতো ভাইয়ের হাতে খুন

কুষ্টিয়ায় রসুন ক্ষেতে মুরগি ঢোকাকে কেন্দ্র করে পারিবারিক বিরোধের জেরে হাফিজুল...

নেত্রকোনা–৩ আসনে মনোনয়ন পেলেন মাওলানা শেখ শামছুদ্দোহা

আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেত্রকোনা–৩ (কেন্দুয়া–আটপাড়া)...

মহান বিজয় দিবসে শহিদদের প্রতি জেলা পুলিশের শ্রদ্ধা

আজ ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূ...

বিজয় দিবস উপলক্ষে আমাদের উত্তরা ফাউন্ডেশনের বর্ণাঢ্য বিজয় র‍্যালি

যথাযোগ্য মর্যাদা ও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মহান বিজয় দিবস উদযাপন ক...

কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় ২ পুলিশ সদস্য নিহত

কুষ্টিয়ায় ছবি তুলতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় পাবনা জেলায় কর্মরত ডিএসবি’র ইন্স...

সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপে অবৈধ আর্টিসানাল ট্রলিং বোট, জালসহ আটক ১৬

সেন্টমার্টিনের ছেঁড়া দ্বীপে অবৈধ আর্টিসানাল ট্রলিং বোট ও ট্রলিং জালসহ ১৬ জন জ...

টেকনাফে তিন কোটি টাকার ইয়াবাসহ এক রোহিঙ্গা বিজিবি জালে

কক্সবাজারের টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ৩ কোটি...

লোহাগাড়ায় যৌথবাহিনীর অভিযানে ইয়াবাসহ আটক ১

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় যৌথবাহিনীর অভিযানে ইয়াবাসহ এক ব্যক্তিকে আটক করা...

রাঙ্গুনিয়ায় দুই কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ৩ জন আটক

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ‘ডেভিলহান্ট ফেজ-২’ অভিযানে পৃথক স্থানে অভ...

গর্জনিয়া ফাঁড়ি, ঈদগড় ক্যাম্প ও ঈদগাঁও থানা পরিদর্শনে পুলিশ সুপার

কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার জনাব এ.এন.এম. সাজেদুর রহমান গর্জনিয়া পুলিশ ফাঁড়ি...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা