জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো আবারও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ অভিযোগ করে বলছেন, এটি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা, এর মাধ্যমে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। তাদের দাবি, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দলগুলো। মূলত সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি।
বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শুরুতে সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। এ নিয়ে সংলাপে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য তুলে ধরেছেন তারা। সংলাপ চলাকালে একই ইস্যুতে রাজপথে কর্মসূচি ঘোষণা করায় ক্ষোভও প্রকাশ করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা, এর মাধ্যমে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে।
তাদের দাবি, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দলগুলো। অনেকে এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসরণের কথা বলেছেন।
প্রস্তাবিত জুলাই সনদের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ বিদ্যমান সংবিধান এবং সব রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার আইনসম্মত উপায়ে সম্পন্ন করার অভিপ্রায় প্রকাশ করছে। এর উদ্দেশ্য হলো সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। সাত দফা অঙ্গীকারনামা সংবলিত জুলাই জাতীয় সনদের যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সুপারিশ তুলে ধরেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের তরফে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ- এই চার পদ্ধতির মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ এসেছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে গণভোট, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ, গণপরিষদ গঠন করে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা বাস্তবায়নসহ সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ এসেছে।
এখন সনদ বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বুধবারও আলোচনা করেছে ঐকমত্য কমিশন।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈঠকে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের অভিমত উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন সরকার সাংবিধানিক কি না। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই সংবিধান মেনে এই সরকার গঠিত হয়েছে। তাই সনদের যেসব বিষয় সংবিধান-সম্পর্কিত, তা বাস্তবায়নের আগে বিচার বিভাগের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। সাংবিধানিক আদেশ আজ বা কাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে, কিন্তু জাতির সামনে খারাপ উদাহরণ তৈরি করা ঠিক হবে না।
সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা বলেন, সবাই মতামত দিলে বিবেচনা করা যায়। তবে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সনদে স্বাক্ষর করেই জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন। এমন কিছু মৌলিক সংস্কারমূলক বিষয় আছে, যা বাস্তবায়নে সংসদীয় গণভোটেরও প্রয়োজন হতে পারে। তা হলে একই বিষয়ে দুবার গণভোটের প্রয়োজন কেন? এসব বিষয় আলোচনার টেবিলেই নির্ধারিত হওয়া উচিত। তিনি আশা প্রকাশ করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে এবং সংসদ গঠনের পর মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় গণভোট আয়োজনের বিষয়টিও তখন বিবেচনায় আনা যাবে। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, পিআর নিয়ে যারা রাজপথে আন্দোলন করছেন, তা কমিশনের এজেন্ডায় ছিল না। সবার রাজনৈতিক অধিকার আছে যেকোনো বিষয়ে দাবি জানানোর, আমরাও রাজপথে আমাদের বক্তব্য দেব। তবে রাজপথে তো পিআর আদায় করা যাবে না, আলোচনার টেবিলে আসতে হবে। আলোচনার টেবিল রেখে রাজপথে যাওয়া স্ববিরোধিতা। আর এ সব কারণে যদি নির্বাচন অনিশ্চিত হয় বা বাধাগ্রস্ত হয়, তা হলে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং অসাংবিধানিক শক্তি লাভবান হবে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে, এরপর সে বিষয়ে গণভোটের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এই গণভোট হবে। আমরা চাই, জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট দেওয়া হোক। এতে সংস্কারের বিষয়ে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে। কেউ কেউ বলছেন, এটা নির্বাচনের আগে সম্ভব না। কিন্তু আমরা মনে করি, সেটা সম্ভব। শুধু ব্যবস্থাপনার ব্যাপার।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তারাই গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করবেন, কতটুকু সংস্কার হবে, কী কী সংস্কার হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাই না। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। তা এই সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আমাদের মতামত জানাব।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের প্রস্তাবকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। বিশেষ করে আমরা আগে থেকেই গণভোটের কথা বলেছি। সেটি নির্বাচনের আগে হোক বা পরে হোক। গণভোট হতে হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে হবে না। কারণ যেখানে এখনই বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধ, সেখানে পরবর্তী সরকার করবে কি না সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
তিনি মনে করেন, নির্বাচন যতো দেরি হবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব অ্যাডভোকেট রেদোয়ান আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত বিষয়ে কথা বলেছেন। নতুন করে জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ সামনে আনা হয়েছে। অথচ এর কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালতের নির্দেশনার ভিত্তিতে। এটি আমাদের সংবিধানকে পাশ কাটানোর চেষ্টা। এটার পক্ষে আমরা নেই। পরবর্তী নির্বাচন হবে, আমরা সেটাই চাই। নতুন কোনো আদেশের বিষয় চাই না।
তিনি বলেন, যেসব প্রস্তাব সাংবিধানিক না, তা সরকার আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদে কার্যকর হতে পারে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও বিভাজনের দিকে উসকে দিয়েছে। সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারও দলগুলোর দিকে বল ঠেলে দিয়েছে। দায় নিতে চাচ্ছে না। গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি সরকারের কথা নয়। এ নিয়ে হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আরও আলোচনা হবে। যদি জনগণ এটি না মানে তা হলে কী হবে। আওয়ামী লীগের যারা ভোট দেবে তাদের ঠেকানোও কঠিন।
রাশেদ খান বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে যা বাস্তবায়ন হয়, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। সরকার আবার দলগুলোর মধ্যে বিভাজন উসকে দিচ্ছে। সরকার দায় নিতে চায় না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের মতামতে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে জুলাই ঘোষণার ২২-এর ধারা অনুযায়ী এটি করা হবে। অথচ ২৫-এর ধারা অনুযায়ী এটি স্ববিরোধিতা। আবার গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। আমরা মনে করি, বিদ্যমান সরকার যেভাবে ১০৬ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী ক্ষমতায় আছেন, সে রকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না। এরপর একটি অধ্যাদেশ হতে পারে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ-মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, গণভোটের বিষয়টি সংবিধানে নেই। এটি নির্বাচিত সংসদ করবে। আমরা সনদ বাস্তবায়ন চাই। তবে সুরক্ষার জন্য এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারে।
এক মাসের মধ্যে জুলাই সনদ প্রকাশের পাশাপাশি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করার আশা প্রকাশ করেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ। বুধবার দুপুরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে স্বাগত বক্তব্যে তিনি বলেন, কমিশনের মেয়াদ এক মাস বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা কোনো অবস্থাতেই এক মাস সময় নিয়ে এই আলোচনা অব্যাহত রাখতে উৎসাহী নই। আমরা মনে করি না যে আগামী এক মাস ধরে এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আমরা খুব দ্রুত একটা ঐকমত্যের জায়গায় উপনীত হতে পারব।
তিনি বলেন, সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে আমাদের যে বিশেষজ্ঞ প্যানেল আছে তারা দুটো কথা বলেছিলেন, একটি হচ্ছে গণভোট, আরেকটি বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের কথা। সবকিছু বিবেচনা করে প্যানেলের পক্ষ থেকে আমাদের একটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যেটি আপনাদের সামনে আমরা উপস্থাপন করেছি। আমরা সরকারকে একাধিক পরামর্শ দিতে পারি বাস্তবায়নের জন্য, সেটা তুলনামূলকভাবে সরকারের জন্য সহজতর হবে, বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে এবং প্রয়োজনীয় আইনি ও সাংবিধানিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে তারা পদক্ষেপ নিতে পারবেন।
আলী রীয়াজ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য ২১ সেপ্টেম্বর থেকে নিউইয়র্কে থাকবেন।
তিনি ফিরবেন ২ অক্টোবর। আমরা এই প্রক্রিয়ার পরিণতির জায়গা, অর্থাৎ আমাদের দিক থেকে যে সুপারিশ সেটা পেলে প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে তার সঙ্গে আলোচনা করে দিতে চাই। ২১ তারিখের আগে যদি আমরা একমত হতে পারি বা বিকল্পগুলো নিশ্চিত হতে পারি, তা হলে আমাদের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে সেটা তাকে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে। অন্যথায় আমাদের কিছুটা সময় নিতে হবে। আমরা আশা করছি, খুব স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতেই যাতে আমরা এই ধরনের একটা স্বাক্ষরের জায়গায় যেতে পারি। আমি আবারও বলি, কোনো অবস্থাতেই এক মাস ধরে এটা নিয়ে আলোচনার কোনো উদ্দেশ্য, আগ্রহ আমাদের নেই।
আমারবাঙলা/এফএইচ