জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচনের দাবিতে কয়েকটি দল সঙ্গে নিয়ে জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনের বিপরীতে কর্মসূচি নিয়েছে বিএনপি। পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে সারাদেশে নির্বাচনী আবহ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ জন্য সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাই, দলীয় ৩১ দফা ও ইতিবাচক কাজ প্রচার, ভোটারের মন জয়ে বাড়ি বাড়ি যাওয়া, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করবেন নেতারা।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দলীয় সূত্রগুলো এ তথ্য জানিয়েছে। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী এই দলগুলো আলোচনার টেবিল থেকে রাজপথে মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাচ্ছে। যদিও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সব দলকে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দূরত্ব কমিয়ে আনার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল।
বিএনপি মনে করছে, জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনের উদ্দেশ্য নির্বাচনের আগে মাঠের কর্তৃত্ব নিজেদের দখলে রাখা এবং নেতকর্মীদের চাঙ্গা রাখা। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নিজ দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনমুখী করার কৌশল নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীসহ সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে জনসম্পৃক্তিমূলক কাজ বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু, জুলাই সনদের অধীনে জাতীয় নির্বাচনসহ কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে মাঠে নামছে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ একাধিক সমমনা দল। প্রাথমিকভাবে এই দলগুলো ঢাকাসহ দেশব্যাপী তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ধারাবাহিকভাবে আরও কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে। বিএনপি মনে করছে, সরকার ও বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসেবেই এ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এর বিকল্প হিসেবে নিজ দলের নেতাকর্মীদের মাঠে নামানোর কৌশলকেই উত্তম বলে মনে করছেন তারা।
বৈঠকে একাধিক বিএনপি নেতা বলেন, জামায়াত একদিকে সারাদেশে নিজেদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে; বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওই দলের নেতাকর্মীরা গণসংযোগ করছেন। অন্যদিকে, জাতীয় ইস্যু সৃষ্টি করে মাঠ গরমের চেষ্টা চালাচ্ছে।
একাধিক নেতা জানান, জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নামা দলগুলোর বাইরে থাকা দলের সঙ্গে বিএনপির পক্ষ থেকে যোগাযোগ বাড়ানো হবে। এ ছাড়া পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার করা হবে। পাশাপাশি বিএনপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে– এমন দলগুলোর কেউ যাতে জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলনে চলে না যায়, সে বিষয়ে সজাগ থাকার বিষয়ে আলোচনা হয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে।
লক্ষ্য দলকে নির্বাচনমুখী করা
বৈঠকে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য আগামী নির্বাচন সামনে রেখে জনসম্পৃক্ত নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় যাওয়ার প্রস্তাব দেন। পরে আলোচনার মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে নির্বাচনের মাঠে কীভাবে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করা যায় এবং জনগণকে কীভাবে নির্বাচনমুখী করা যায়, সেটি মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।
ইতোমধ্যে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনগণের পাশে থেকে তাদের কল্যাণে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নেতারা জানান, বিএনপি আগামীতে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে চায়। জনগণ সেটি যাতে বোঝে, জনগণের সামনে দৃশ্যমান হয়, বিএনপি সেই ধরনের কর্মসূচি আগামীতে অব্যাহতভাবে পালন করে যাবে।
সূত্র জানায়, বিএনপির পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে প্রতিটি আসনে দলীয় একক প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা থাকবে, যাতে দলের পদপদবির পরিচয়ে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী না হতে পারেন। যদিও এখন প্রায় প্রতিটি আসনে বিক্ষিপ্তভাবে একাধিক প্রার্থী প্রচার ও গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। দলের প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ার আগপর্যন্ত যাতে সম্ভাব্য প্রার্থীরা কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে না জড়ান, সে জন্য কেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
নির্দোষ নেতাকর্মীকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে নানামুখী অপপ্রচার চলছে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা। বিভিন্ন সময়ে অভিযোগের ভিত্তিতে দলের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পরে দেখা গেছে, অভিযোগের সব সত্য নয়। যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি, তাদের স্বপদে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে বিএনপি এখন মনে করছে, এই সাংগঠনিক পদক্ষেপে দলের অভ্যন্তরে একটা শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হয়েছে।
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন
সূত্র জানায়, বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে চরম ভরাডুবি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন বয়কট নিয়ে আলোচনা করেন নেতারা। ওই দুটি নির্বাচন নিয়ে নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, কিছুটা হলেও এই নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। কিন্তু কী জন্য এবং কেন এই অবস্থা হলো– সেসব বিষয়ে অনুসন্ধান করবে দল। যেখানে দুর্বলতা আছে, সংকট আছে, সেসব দূর করার বিষয়েও নেতারা মতামত দেন।
বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই সনদ আর সংস্কার ইস্যু
বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠক শেষে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। যুগপৎ আন্দোলনে নামা জামায়াতসহ অন্যদের কর্মসূচি প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার অধিকার তাদের রয়েছে।
বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাব ছাড়া অন্যগুলো এই সরকার এখনই বাস্তবায়ন করতে পারবে এবং করে যাচ্ছে। তারা যেগুলো শেষ করতে পারবে না, সেটি পরবর্তী সরকার করবে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ভিন্ন পন্থা বের করার জন্য বিএনপি সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আরও কোনো বৈধ পন্থা বের করা সম্ভব হলে তাতেও বিএনপির আপত্তি নেই। কী কী পন্থা হতে পারে, সেটি হয়তো আমরা আলোচনার মধ্য দিয়ে বের করতে পারব। সেই আলোচনা অব্যাহত আছে।
আমারবাঙলা/এফএইচ