দেখার পর সিনেমাটির অনেকগুলো দৃশ্য চোখে ভাসতে থাকবে, তা নিশ্চিত। কফি হাউসের সারি সারি সাজানো টেবিল, টংদোকানে চা, কাঁসার থালায় কলাপাতার ওপরে ভাত আর ইলিশভাজি, সেই সাদা-কালো সিনেমার সময়ের নায়ক-নায়িকা, সেতার আর পিয়ানোর একসঙ্গে বেজে ওঠা, মেজাজের পারদ চড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবজি কাটার দৃশ্য, হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বৃষ্টিতে গঙ্গার পাড়-সবটাই সুন্দর, সিনেম্যাটিক। অনেকেই হয়তো বুঝে গেছেন, হচ্ছিল ‘আপ জ্যায়সা কোই’ সিনেমার কথা। ১১ জুলাই ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে মুক্তির পর সিনেমাটি নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনায়। এ সিনেমায় নির্মাতা প্রধানত দুটি বিষয় তুলে ধরতে চেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনোভাব আর যৌনতায় নারীর চাওয়াকে ট্যাবু ভাবার প্রবণতা। চিন্তা খারাপ নয়, কিন্তু নির্মাণগুণে উতরে যেতে পারল কি সিনেমাটি?
৪২ বছরের মধ্যবয়সী অবিবাহিত পুরুষ শ্রীরেণু ত্রিপাঠি ওরফে শ্রী (আর মাধবন) জামশেদপুরের সরকারি স্কুলে সংস্কৃতের শিক্ষক। তিনি একটু প্রাচীনপন্থী। এখনো বইয়ের ভাঁজে ফুল গুঁজে রাখেন। আর অতি অবশ্যই তিনি মধুবালার ভক্ত। কে জানত, তাঁর জীবনে সত্যি সত্যিই মধু আসবে! শ্রীর ভাবি কুসুম (আয়েশা রাজা) দেবরের জন্য হন্যে হয়ে মেয়ে খুঁজছেন। শ্রীরেণুর এই একা জীবনে একটু উত্তেজনা ছড়াতে তাঁর বন্ধু সুমিত (নমিত দাস) তাঁকে একটি ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করতে বলেন। বন্ধু এই ৪২ বছরে এসেও ভার্জিন, এটা নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত তিনি। ডেটিং অ্যাপে প্রথম রাতে শ্রীর জীবনে এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়, যা তাঁর ৪২ বছরের জীবনে প্রথম!
এর মধ্যে শ্রীর জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ আসে। পাত্রী মধু বোস (ফাতিমা সানা শেখ)। কলকাতায় থাকেন, ফ্রেঞ্চ পড়ান। প্রথম দেখায় মধু বোসকে দেখে মাথা ঘুরে যায় শ্রীর। মধু বোসের মতো সুন্দরী, শিক্ষিত মেয়ে শ্রীরেণুর মতো কাউকে পছন্দ করবেন, তা শ্রী বিশ্বাসই করতে পারেন না। চলে ঘটনার পেছনে তদন্ত-তালাশ। কিন্তু ইতিমধ্যে মধুর আরও কাছে চলে আসেন শ্রী। দুজনই পছন্দ করে ফেলেন দুজনকে। দুই বাড়িতে বিয়ের কথা পাকা হয়। আর তখনই শ্রী জানতে পারেন এমন এক কথা, যা তাঁর সংস্কারকে নাড়িয়ে দেয়। মধুর এ আচরণ মানতে পারেন না শ্রী। পাকা কথা হয়েও বিয়ে ভেঙে যায়। কী করেছিলেন মধু, যার জন্য শ্রী তাঁকে মন থেকে মেনে নিতে পারেন না? মধু কি শ্রীকে বোঝাতে পারেন? নাকি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আবারো হার মানতে হয় নারীকেই?
এ সিনেমা দেখার সময় আপনি একটা দ্বিধার মধ্যে থাকবেন। প্রোডাকশন, শিল্প নির্দেশনা, সেট-সবকিছু বেশ ভালো; এমনিতে দেখে যেতে মন্দ লাগবে না। দেবজিৎ রায়ের সিনেমাটোগ্রাফিও ভালো লাগবে। কিন্তু সিনেমার যে মূল বক্তব্য মাঝেমধ্যেই যেভাবে মোটাদাগে হাজির করেছেন নির্মাতা, তাতে একটু বিরক্তও হবেন। তিনি আরো একটু বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে কি পারতেন না?
পুরুষতান্ত্রিকতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চেয়েছে এ সিনেমা। ভালো কথা, কিন্তু সেটা একটু পরপরই নির্মাতা যেভাবে গলাধঃকরণ করাতে চেয়েছেন যে মনে হয়, এতটা না করলেও সিনেমার বক্তব্য বুঝতে কারও অসুবিধা হতো না। সিনেমায় পুরুষতন্ত্রের অন্যতম প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে শ্রীর ভাই ভানু ত্রিপাঠিকে (মনীশ চৌধুরী)। কিন্তু এ চরিত্রও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি যখনই পর্দায় হাজির হয়েছেন, মনে হয়েছে, এই বুঝি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য এবার উঠে আসবে এবং হয়েছেও তা–ই।
তাঁকে যেন এ সিনেমায় নেওয়াই হয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতা হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। তবে তাঁর বলা একটি সংলাপ শুনে না হেসে পারবেন না। ওটিটিতে মুক্তি পাওয়া সিনেমায় যখন তিনি বলেন ‘ওটিটি সবার চিন্তাচেতনা বিগড়ে দিয়েছে’, তখন না হেসে উপায় কী!
সিনেমায় কলকাতার বাঙালিদের হাজির করা হয়েছে ক্লিশেভাবেই। পর্দায় দেখতে ভালো লাগলেও বাঙালি মানেই সবাই প্রগতিশীল, মাছ ছাড়া কিছু বোঝে না—এসব দেখতে দেখতে ক্লান্তও লাগে। স্বাধীনচেতা নারী, পরিবারের পুরুষদের নারীকে অকুণ্ঠ সমর্থনের যে বাঙালি সমাজের চিত্র সিনেমায় ফুটে উঠেছে, সেটা কি সত্যিই পুরো বাঙালি সমাজের চিত্র? পরিচালক এখানে যেন একটু বেশিই নাটকীয়তা করেছেন।
এমনিতে ‘আপ জ্যায়সা কোই’কে বলা যায় গত এক দশকে নির্মিত হিন্দি সিনেমার বিভিন্ন রোমান্টিক কমেডির ‘রিইউনিয়ন’। ‘বদ্রিনাথ কি দুলহানিয়া’, ‘ভিকি ডোনর’, ‘টু স্টেটস’, ‘রকি অউর রানী কী প্রেম কাহানি’, ‘ড্রিমগার্ল’, ‘মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর’ দেখা থাকলে এ সিনেমা দেখতে দেখতে পুরোনো স্মৃতি মনে পড়বেই।
এ সিনেমার প্রথম অংশের গল্পের বুনট যথার্থ হলেও দ্বিতীয় ভাগ থেকেই গল্প যেন খাপছাড়া হতে থাকে। শ্রী আর মধুর মধ্যে প্রেমটা জমে ওঠার আগেই ঘটে যায় একের পর এক ঘটনা। তারপর যখন শ্রী মধুর কাছে আবার ফিরতে চান, তখন গল্পটা যেন শুধু গল্পের মূল বক্তব্য তুলে ধরার দিকেই বেশি নজর দেয়। শ্রী তখন পাগলের মতো ঘুরে বেড়ালেও দর্শক তাঁর অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন না। দ্বিতীয় অংশে মধু যেন একেবারেই ম্রিয়মাণ। অন্যদিকে ‘প্রাচীনপন্থী’ শ্রীর হঠাৎ বদলও ঠিক বোধগম্য হয় না। সিনেমার শুরুতে শ্রীর খাঁচাবন্দী ইঁদুরকে কয়েকবার দেখানো হয়, পরে আর সেই ইঁদুরের হদিস মেলে না। সেই খাঁচাকে নির্মাতা কি রূপক অর্থে দেখিয়েছিলেন? দেখিয়ে থাকলে শেষটাও দেখালে ভালো হতো।
শ্রী আর মধু আপাতদৃষ্টে বিপরীতধর্মী। তবে তাঁরা একে অন্যের প্রেমে পড়েন; কারণ, তখন দুজনই ‘অসহায়’। একবার সম্পর্কে নেই বলে আরেকজন অনেকগুলো বিষাক্ত সম্পর্ক পার করেন। তবে এই প্রেমে পড়ার বিষয়টিও আরেকটু সময় নিয়ে দেখানো যেত।
সিনেমা একটি নির্দিষ্ট সমাজের গুটিকয় মানুষের মানসিকতা তুলে ধরে। কিন্তু এখানে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতরের মানুষের পটভূমিকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যেন এটাই মানদণ্ড নির্ধারণ করছে। ভার্জিনিটি হারানো কিংবা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে এ সিনেমায় খুব সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ এসবের সামাজিক প্রভাব অনেক। কুসুম চরিত্রটির যে পরিণতি দেখানো হয়েছে, সেটা যেন কেবল চমকের জন্যই। চাইলে এটা আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যেত।
তবে এখনো পুরুষপ্রধান সমাজে নারীর সীমা পুরুষই নির্ধারণ করে দেন কিংবা নারী নিজের মত বা চাহিদা প্রকাশ করলেই তিনি খারাপ, এটাও হামেশাই দেখা যায়। সিনেমায় এ বিষয়গুলোই উঠে এসেছে ভালোভাবে। যে কাজটা নারী-পুরুষ দুজনই করতে পারেন, তা নারীরা করলেই দোষ-সমাজের এ চিন্তাকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এ সিনেমা।
বিবেক সোনির সিনেমায় নারী চরিত্রেরা পুরুষের চেয়েও উজ্জ্বল হন। ‘মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর’-এ যেমন ছিলেন সানিয়া মালহোত্রা, তেমনি এ সিনেমায় ফাতিমা সানা শেখও মাধবনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। ‘মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর’–এ নায়ককে সব সময়ই নীল রঙের পোশাক পরতে দেখা যায়; কারণ, এই রঙে সে নিরাপদ বোধ করে। নির্মাতার নীল-প্রীতি এ সিনেমায়ও আছে। তবে সেটা স্থানান্তরিত হয়েছে নায়িকার ক্ষেত্রে, কফি হাউসে নীল শাড়িতে যখন ফাতিমা হাজির হন, তখন দেখতে মন্দ লাগে না। বাঙালি নারীর চরিত্রে তিনি মানিয়েছেন ভালো।
ইদানীং ধূসর চরিত্রেই বেশি মনোযোগী হয়েছেন আর মাধবন। অনেক দিন পর এ সিনেমায় পাওয়া গেল সেই পুরোনো মাধবনকে এবং তিনি যে দারুণ কাজ করেছেন, বলাই বাহুল্য। শান্ত, ভদ্র, লজ্জাশীল একজন অবিবাহিত পুরুষের চরিত্রে তিনি মানিয়েছেন খুব ভালো। মাধবনের সঙ্গে ফাতিমার রসায়নও জমেছে ভালো। শ্রীরেণুর ভাই ভানুর চরিত্রে মনীশ চৌধুরী, কুসুম চরিত্রে আয়েশা রাজা ও দীপকের চরিত্রে নমিত দাসও ঠিকঠাক। তবে নিশা চরিত্রে শ্রিয়াম ভাগনানি যেভাবে দুঃখভরা চোখ দিয়ে নিজের ভাগ্যকে মেনে নেওয়ার জায়গাটা ফুটিয়ে তুলেছেন, তা গল্পে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
এ সিনেমার আরেকটি ভালো দিক সফট মেলোডি গানগুলো। ‘যাব তু সাজন’ গানের মাধ্যমে পাওয়া গেল চেনা মোহিত চৌহানকে। অন্য গানগুলো শুনতে যেমন ভালো, দেখতেও ভালো। জাস্টিন প্রভাকরণ ও রোচাক কোহলি সুরকার হিসেবে ভালো কাজ করেছেন।
‘আপ জ্যায়সা কোই’ নামটি নেওয়া হয়েছে ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া ফিরোজ খানের সিনেমা ‘কুরবানি’র নাজিয়া হাসানের জনপ্রিয় গান থেকে। এত বছর পরও গানটি মনে রেখেছেন অনেক দর্শক-শ্রোতা। তবে একই নামের সিনেমাটির কথা পাঁচ দশক পর মনে থাকবে কি না, না বলা কঠিন।
একনজরে
সিনেমা: ‘আপ জ্যায়সা কোই’
পরিচালক: বিবেক সোনি
জনরা: রোমান্টিক ড্রামা
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
রানটাইম: ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট
অভিনয়ে: আর মাধবন, ফাতিমা সানা শেখ, মনীশ চৌধুরী, আয়েশা রাজা, নমিত দাস, অনন্যা চ্যাটার্জি
আমারবাঙলা/জিজি