উৎসব বা আনন্দ করতে গিয়ে অনেক সময় নিরানন্দে পরিণত সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। তাই যথাযথ ট্রাফিক নিয়ম প্রয়োগ করা জরুরি। দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
কোরবানির ঈদের আগে ও পরে মিলিয়ে ১৫ দিনে দেশে ৩৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন ১১৮২ জন। গেল বছরের কোরবানির ঈদের সাথে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২২ দশমিক ৬৫ শতাংশ, প্রাণহানি ১৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
আর সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে ৪১৫টি দুর্ঘটনায় ৪২৭ জন নিহত এবং ১১৯৪ জন আহত হয়েছেন বলে তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
এ সংগঠনের পরিসংখ্যান বলছে, গেল বছরের কোরবানির ঈদের সাথে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২২ দশমিক ৬৫ শতাংশ, প্রাণহানি ১৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৫৫ দশমিক ১১ শতাংশ। আগের বছরের ঈদুল আজহায় ৩০৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৬ জনের প্রাণহানি হয়েছিল এবং ৭৬২ জন আহত হয়েছিলেন।
এবারে ঈদের আগে ছুটি কম হওয়ায় এবং ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত একসাথে হওয়ার কারণে গেলবারের তুলনায় এবারে সড়কে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলে তাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে এই সংগঠনটি।
তাই দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার একগুচ্ছ সুপারিশে তারা ঈদের ছুটি বাড়ানোর বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করেছে। বিশেষ করে ঈদের আগে যাত্রা স্বস্তিদায়ক করতে চারদিন ছুটির সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে, এবারে ছুটি ছিল দুদিন।
সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী সোমবার ঢাকার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এবারের ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ঈদযাত্রা শুরুর প্রথম দিন ৩১ মে থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরার দিন ১৪ জুন পর্যন্ত ১৫ দিনেন দুর্ঘটনার তথ্য এসেছে এ প্রতিবেদনে। বরাবরের মতই সংবাদমাধ্যমে আসা দুর্ঘটনার খবর সংকলিত করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, রেলপথে ২৫টি দুর্ঘটনায় ২৫ জন নিহত হয়েছেন আর আহত হয়েছেন ১২ জন। নৌ-পথে ১১টি দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত ও ৬ জন নিখোঁজ থাকার তথ্য দিয়েছে সংগঠনটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরাবরের মত এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৩৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত ও ১৪৮ জন আহত হয়েছে। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫.৩৫ শতাংশ।
ঈদের সড়কে এবার মোটরসাইকেল চলাচলে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। বিপুল সংখ্যক মানুষ এবার মোটরসাইকেলে করে ঢাকা থেকে বাড়ি গেছেন।
এবার ঈদযাত্রায় সড়কে দুর্ঘটনায় হতাহতদের মধ্যে ৬১ জন চালক, ৫০ জন পরিবহণ শ্রমিক, ৫৮ জন পথচারী, ৪০ জন নারী, ৩০ জন শিশু, ৩২ জন শিক্ষার্থী, ৭ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ৫ জন শিক্ষক, ১ জন চিকিৎসক, ১ জন প্রকৌশলী, ৮ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর পরিচয় মিলেছে বলে জানিয়েছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
যেসব বাহন দুর্ঘটনায় পড়েছে, সেগুলোর ২৬.৫৪ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৮.৫৮ শতাংশ বাস, ১৩.৬২ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১৯.১১ শতাংশ ট্রাক-কভার্ডভ্যান, ৭.৪৩ শতাংশ কার-মাইক্রোবাস, ৭.৬১ শতাংশ নছিমন-করিমন ও ৭.০৭ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা।
এসব দুর্ঘটনার ২৮.২৩ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪০.৬৩ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেয়ার ঘটনা, ২০.০৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ০.৭৯ শতাংশ ট্রেন-যানবাহনে ও ১০.২৯ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে তারা বলছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৭.২০ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২৮.২৩ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৮.৪৯ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪.৪৮ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ০.৭৯ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ০.৭৯ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংগঠিত হয়েছে।
কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়েছে ৭ জুন। ঈদের আগে ৫ জুন থেকে পরবর্তী ১৪ জুন পর্যন্ত টানা ১০ দিনের ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সরকারি ছুটিকে অনুসরণ করে ব্যাংক, এনজিওসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বাড়তি ছুটি দেয় ঈদ উপলক্ষে।
সংবাদ সম্মেলন মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “দেশের সড়ক-মহাসড়কের বৃষ্টির কারণে ছোট বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এসব গর্তে বেপরোয়া যানবাহন দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছে।
“ঈদের পরে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা বিরামহীন ও বিশ্রামহীনভাবে যানবাহন চালাতে গিয়ে সংগঠিত হয়েছে। ফলে এসব দুর্ঘটনায় সিংহভাগ খাদে পড়ে ও দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনের লেগে যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটেছে।”
তিনি বলেছেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও পথে পথে যাত্রী হয়রানি এবারের ঈদেও চরমে ছিল। গণপরিবহনগুলোতে ঈদকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের কারনে বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে, খোলা ট্রাকে, পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দরিদ্র লোকজনদের ঈদে বাড়ি যাতায়াত করতে হয়েছে।
“ঈদের যাতায়াত ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। সবার আগে আমাদের গণপরিবহন ও ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বাড়াতে হবে, ছোট যানবাহন মহাসড়ক থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। প্রশিক্ষিত দক্ষ চালক, ফিটনেস বিহীন যানবাহন, মানসম্মত সড়কের পাশাপাশি আইনের সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।”
দুর্ঘটনার কারণ কী কী
দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
১. ঈদের আগে ছুটি কম থাকায় একসাথে বেশি মানুষ রাস্তায় নামায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি।
২. সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিক্সা অবাধে চলাচল।
৩. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা।
৪. সড়কে মিডিয়ান বা রোড ডিভাইডার না থাকা, সড়কে গাছপালায় অন্ধকারের সৃষ্টি।
৫. মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্র্যাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা।
৬. উল্টোপথে যানবাহন, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহণ।
৭. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রীবহন।
৮. বেপরোয়া যানবাহন চালানো এবং বিরামহীন ও বিশ্রামহীনভাবে যানবাহন চালানো।
৯. বৃষ্টিতে সড়কের মাঝে গর্তের সৃষ্টি, ভাঙ্গাছেঁড়া সড়ক।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির সুপারিশ
১. মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি ও নিবন্ধন নিয়ন্ত্রণ করা।
২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা।
৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস প্রদান।
৪. গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কে ফুটপাতসহ সার্ভিস লেইনের ব্যবস্থা করা।
৫. সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা।
৬. মহাসড়কে ফুটপাত ও পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা রাখা, রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা।
৭. সড়ক পরিবহণ আইন উন্নত বিশ্বের আদলে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রয়োগ করা।
৮. সারাদেশে উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৯. মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা।
১০. মেয়াদোত্তীন গণপরিবহন ও দীর্ঘদিন যাবৎ ফিটনেসহীন যানবাহন স্ক্র্যাপ করার উদ্যোগ নেওয়া।
১১. ঈদের আগে ঈদের ছুটি ৪ দিন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
১২. ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী চালকের উপর চাপিয়ে দেওয়া ভ্যাট ও আয়কর অব্যাহতি দিতে হবে।
আমারবাঙলা/ইউকে
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            