ছবি: সংগৃহীত
জাতীয়

চিরনিদ্রায় শায়িত বেগম খালেদা জিয়া, দেশজুড়ে শোকের ছায়া

রিয়াদুর রহমান পিনজু

চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর এ মৃত্যুতে দেশজুড়ে বইছে শোকের ছায়া।

দীর্ঘ রাজনীতির ইতি টেনে মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) ভোর ৬টার দিকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা সম্পন্ন হয়। তাঁর জানাজাকে ঘিরে জাতীয় সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী, সাধারণ জনতা ও বিভিন্ন মহলের মানুষের সমাগম ঘটে। বেলা সাড়ে চারটার পর রাজধানীর জিয়া উদ্যানে, তাঁর স্বামী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।

জানাজার পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে পরিবারের পক্ষ থেকে সকলের কাছে দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন খালেদা জিয়ার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

তারেক রহমান বলেন, খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালীন তাঁর কোনো ব্যবহার বা কথায় যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর পক্ষ থেকে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আপনারা সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন। আমি মরহুমা বেগম খালেদা জিয়ার বড় সন্তান। এখানে উপস্থিত সকল ভাই ও বোনদের উদ্দেশে বলতে চাই, মরহুমা যদি কারও কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, তাহলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। ইনশাআল্লাহ আমি তা পরিশোধ করব।

খালেদা জিয়ার জানাজা শেষে রাজধানীর উত্তরা থেকে আসা আশিক মাহমুদ আমার বাঙলাকে বলেন, আধিপত্যবাদী শক্তি ও ফ্যাসিবাদীদের সঙ্গে আপস না করে এর বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ানোর মতো মনোবল ও হিম্মত যাদের ছিল, তাদের মাঝে অন্যতম খালেদা জিয়া। আপসহীন একজন মানুষের ঐতিহাসিক বিদায়ে অংশ নিতে পেরে খুবই ভালো লাগছে, আলহামদুলিল্লাহ। যে জুলাইয়ের জন্য ও জুলাই শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ঐতিহাসিকভাবে বিদায়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে, সে জুলাইয়ের চেতনা ও শহীদদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেই বেগম জিয়ার বিএনপি যুগ যুগ টিকে থাকুক।

জানাজায় অংশ নিয়ে মো: জাকারিয়া আমার বাঙলাকে বলেন, তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করলাম। দেখলাম লাখো মানুষের ভিড়। আসলেই তিনি একজন দেশপ্রেমিক এবং আপসহীন নেত্রী। তিনি বিশ্বের দরবারে অতুলনীয় এক নেত্রী। তাঁর চলে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য অপুরণীয় ক্ষতি।

বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় সংসদ ভবন এলাকা থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার পর্যন্ত সড়কে বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশ নেন। এছাড়া আসাদ গেট থেকে মোহাম্মদপুর টাউন হলের কাছাকাছি পর্যন্ত, আগারগাঁও মেট্রো স্টেশন থেকে শিশু মেলা (শ্যামলী) পর্যন্ত এলাকায়ও অসংখ্য মানুষ জানাজায় উপস্থিত ছিলেন।

তার মৃত্যুতে আজ বুধবার থেকে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত তিন দিনের রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক ঘোষনা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে এবং জানাজার জন্য আজ বুধবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ঘোষণা দেন।

এছাড়া গতকাল মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সারাদেশে দোকানপাটও বন্ধ রাখার জন্য দোকান ব্যবসায়ীদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ জানানো হয়েছিল বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে।

বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শ, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা খুব সহজেই মানুষের মাঝে জায়গা করে নিয়েছিলেন।

তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ইতিহাসে স্থান করে নেন; একই সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকারপ্রধান হিসেবেও তাঁর নাম উল্লেখযোগ্য।

১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় খালেদা জিয়ার জন্ম। তাঁর পিতা ইস্কান্দার মজুমদার ও মাতা তৈয়বা মজুমদার। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসে। তাঁদের পারিবারিক শিকড় ফেনীতে। শিক্ষাজীবনে তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৬০ সালে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর খালেদা জিয়া দেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরে অংশ নেন। এই সময় তিনি যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিত করে তোলে।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্যের হাতে জিয়াউর রহমান নিহত হলে দেশের রাজনীতিতে গভীর সংকট দেখা দেয়। সে সময় দুই সন্তানকে নিয়ে খালেদা জিয়া ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন। নেতৃত্বহীন ও বিপর্যস্ত বিএনপির হাল ধরার প্রশ্নে আলোচনার মধ্যেই ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি দলের প্রাথমিক সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় হন।

অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্বগুণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পান। একই বছরের মে মাসে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩, ২০০৯ ও ২০১৬ সালের কাউন্সিলেও তিনি পুনরায় এই দায়িত্বে নির্বাচিত হন।

দলের নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকেই তাঁকে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হয়। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আপসহীন আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কোনো ধরনের সমঝোতায় না গিয়ে তিনি রাজপথের আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। এর ফলেই এরশাদ সরকারের পতন ত্বরান্বিত হয় এবং ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠনের সুযোগ পায়।

১৯৯১ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। এরপর ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে জোট সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে তৃতীয়বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি দুইবার সার্কের চেয়ারপারসনের দায়িত্বও পালন করেন।

২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ সময় কারাবন্দি থাকার পর তিনি একে একে মামলাগুলোতে জামিন লাভ করেন। কারাবাসকালে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব এলেও তিনি দেশ ছাড়তে রাজি হননি।

২০১০ সালে তাঁকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়—যেখানে তিনি প্রায় তিন দশক বসবাস করেছিলেন। এক-এগারোর সরকার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় খালেদা জিয়ার দুঃসহ কারাবন্দী জীবন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম ট্র্যাজেডি। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা এবং দীর্ঘদিন তাঁকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত নিপীড়নের মুখোমুখি হয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ওয়ান ইলেভেন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তাঁকে বারবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে দুর্নীতির মামলায় কারাবরণ এবং তারপর শারীরিক অসুস্থতা; এসব কারণে ২০১৮ সাল থেকে বিএনপির রাজনীতিতে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তবুও শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর লড়াই করেছে তাঁর নেতৃত্বাধীন দলটি। দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর মতোই তার মাশুল দিয়েছেন খালেদা জিয়া নিজেও। অত্যন্ত খারাপ শারীরিক অবস্থাতেও দীর্ঘদিন অন্যায়ভাবে জেলে আটক ছিলেন। পরবর্তীতে এই অসুস্থতাই তাঁকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নির্যাতন, কারাবাস ও চাপের মুখেও তিনি কখনো আপস করেননি। দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে তিনি নিজের অবস্থানে অটল থেকেছেন। এ কারণেই বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন হয়ে উঠেছে আপসহীন সংগ্রাম ও নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস ও কিডনিসহ নানা জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে গত ২৩ নভেম্বর তাঁকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি মেডিকেল বোর্ড তাঁর চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করছিল। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার উদ্যোগ থাকলেও শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

৮০ বছরের খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাঁর দল বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছেন এবং বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। তাঁর এ বিদায় কাঁদিয়েছে বাংলার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে।

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হবে বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন সাবেক প্রধানমন্...

রাতভর টহলে ট্যুরিস্ট পুলিশ, নিরাপদ কক্সবাজারে স্বস্তিতে পর্যটকরা

থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আগত দেশি-বিদেশি পর্যটকদের...

খালেদা জিয়ার জানাজা বুধবার, দাফন হবে শহীদ জিয়ার সমাধিতে

বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নামাজে জানাজা আগাম...

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে মনোহরদীতে দোয়া, মোনাজাত ও কালো ব্যাজ ধারণ

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে সারা...

মৌলভীবাজার-৪ আসনে নির্বাচনী মাঠে পিতা ও পুত্র

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬-এ মৌলভীবাজার-৪ (কমলগঞ্জ–শ্রীমঙ্গ...

চিরনিদ্রায় শায়িত বেগম খালেদা জিয়া, দেশজুড়ে শোকের ছায়া

চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর এ মৃত্যুতে দেশজুড়ে বইছে শোকের ছা...

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে মনোহরদীতে দোয়া, মোনাজাত ও কালো ব্যাজ ধারণ

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে সারা...

চিরনিদ্রায় সমাহিত করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চিরনিদ্রায় সমাহিত...

মরহুমা কারও থেকে ঋণ নিয়ে থাকেলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন: তারেক রহমান

জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম...

আশ্রয়ন প্রকল্পে অভিযান, চারটি এয়ারগান উদ্ধার র‍্যাবের

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলাধীন কামদপুর আশ্রয়ন প্রকল্পের ঝোপে অভিযান চালিয়েছে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা