সংগৃহীত ছবি
রাজনীতি

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ কিংবা সঠিক কাজের ভুল প্রক্রিয়া

কাজী জহিরুল ইসলাম : বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল বা তার অঙ্গ সংগঠন নিষিদ্ধ করার নজির কম নেই। কিন্তু গত তিন মাসে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও প্রত্যাহারের একাধিক ঘটনা যেভাবে ঘটল, এর নজির বেশি নেই।

হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন দৃশ্যত আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এক নির্বাহী আদেশবলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও তার অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এর তিন দিনের মাথায় গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ও দেশত্যাগ ঘটে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরও নিষেধাজ্ঞামুক্ত হয় নতুন সরকারের সিদ্ধান্তের বলে। আর আড়াই মাসের মাথায় নতুন সরকার আবার ছাত্রলীগকে নির্বাহী আদেশবলে নিষিদ্ধ করে। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের খবরে অনলাইন ও অফলাইনে বেশির ভাগ মানুষই আনন্দ প্রকাশ করেছেন; ক্ষোভ ও হতাশাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।

স্বীকার করতে হবে, গত দেড় দশকে ছাত্রলীগ এত অপরাধ করেছে, তাতে নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপটি জনসাধারণের সমর্থন সহজেই পেয়েছে। এ ছাড়া জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আন্দোলনকারীদের ৯ দফার একটি ছিল ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা।

ছাত্রলীগের মতো জনবিরোধী অবস্থান নেওয়া কোনো সংগঠনকে ছাত্র-জনতা আন্দোলনের মাঠ থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাতেই পারে। এটি যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত দাবি। কিন্তু সরকার যখন নির্বাহী আদেশে সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে, তখন সেই সিদ্ধান্ত ভুল। সঠিক কাজটিই হয়তো করা হয়েছে, কিন্তু ভুল প্রক্রিয়ায়।

যেমন আন্দোলনের মাঠ থেকে আমরা অনেক সময় স্লোগান তুলি ‘অমুকের ফাঁসি চাই’। আসলে আমরা কী চাই? আমরা চাই ন্যায়বিচার। এখন, যদি ন্যায়বিচারের মাধ্যমে বা যথাযথ বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আইনের মাধ্যমে কারও ফাঁসি হয়, তো হতে পারে। কিন্তু আন্দোলনের ভাষায় নির্বাহী বিভাগ চলতে পারে না। যদি চলে, তাহলে সেটি দেশের জন্য কখনোই কল্যাণকর হবে না। নির্বাহী বিভাগকে সঠিকভাবে আন্দোলনের ভাষা অনুবাদ করা শিখতে হবে।

রাস্তায় ধরে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে কিংবা ছাত্রাবাসের ভেতরে আবরারকে পিটিয়ে হত্যাসহ আক্ষরিক অর্থেই শত শত হত্যাকাণ্ডের কথা বলা যায়, যা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী সংঘটিত করেছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাস-দাসীর মতো ব্যবহার, এমনকি ‘ধর্ষণের সেঞ্চুরি’সহ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হাজারো অপরাধের ফিরিস্তি দেওয়া যায়। আবার ৭৬ বছরের কাল-পরিক্রমায় বহু সফল ও প্রয়োজনীয় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। যখন পুরো সংগঠনকেই নিষিদ্ধ করা হয়, তখন বিভিন্ন সময় ও পর্যায়ে এর সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার আদর্শবান নেতাকর্মীর কপালেও এই কলঙ্কের দাগ লেগে যায়।

প্রশ্ন হচ্ছে, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে কী করা যেত বা যৌক্তিক হতো? যেহেতু এখন দেশে সংসদ নেই, একাধিক রাজনৈতিক, সামাজিক ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যেত। আদালতের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেত। তার বদলে নির্বাহী আদেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ভালোমন্দের পার্থক্য করার সুযোগ থাকছে না।

আমি মনে করি, ছাত্রলীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শর্তযুক্ত হতে পারত। এর কার্যক্রম আগামী ৫ বা ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা যেত। এতে তাদের আত্মশুদ্ধির সুযোগ থাকত এবং অতীতে যেসব সৎ ও ত্যাগী শিক্ষার্থী এই সংগঠনে যুক্ত ছিলেন; দেশের জন্য কাজ করেছেন, তাদের অবদানের স্বীকৃতি সমুন্নত থাকত।
বিশ্বে কি নিষিদ্ধ সংগঠন নেই? হ্যাঁ, অনেক আছে। যেমন জার্মানির নাৎসি গ্রুপ। এই সংগঠন হিটলারের শাসনামলে কোনো কারণ ছাড়াই জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের নামে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা করেছে। হিটলারের পতনের পর এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রায় ৮০ বছর হতে চলল, কেউ এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি তোলেনি। শুধু তাই না, হ্যামারস্কিনস নামে একটি সংগঠনকে ২০২৩ সালে জার্মানি নিষিদ্ধ করে ‘নতুন নাৎসি’ আখ্যা দিয়ে।

ছাত্রলীগও অনেকটা নাৎসি স্টাইলে ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন এবং অনেক ক্ষেত্রে হত্যা করেছে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, নাৎসি গ্রুপের জন্মই হয়েছিল ইহুদি নিধনের জন্য; হিটলারের পতনের পর এর কোনো জনসমর্থন নেই। কিন্তু ছাত্রলীগের জন্ম হয়েছিল একটি জাতির ন্যায়সংগত দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য। গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সংগঠনটি গত দেড় দশকে কলুষিত হলেও, এমনকি শেখ হাসিনার পতনের পরও এর কিছু জনসমর্থন রয়েছে।

মনে রাখতে হবে, কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করা রাষ্ট্রের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ, যদি সেই গোষ্ঠীর কিছুসংখ্যক সক্রিয় কর্মী থাকে। নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তারা গোপনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এবং আগের চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। যেহেতু নিষিদ্ধ ঘোষিত, তাদের নজরদারি ও আইনের আওতায় আনতে গিয়ে সরকারের ঝামেলা বাড়ে।

ছাত্রলীগের যেসব কর্মী অপরাধ করেছে, তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচার করা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। তার বদলে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করতে গিয়ে প্রকারান্তরে দায়মুক্তির আশঙ্কাই বড় হয়ে ওঠে।

লেখক : কাজী জহিরুল ইসলাম: কবি ও জাতিসংঘ কর্মকর্তা

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

এমিতে ‘অ্যাডোলেন্স’-এর জয়জয়াকার

বাংলাদেশ সময় সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে ঘোষণা করা হলো ৭৭তম এমি অ্যাওয়ার্ডস।...

লন্ডনে বাংলাদেশি মাকে ‘বর্ণবাদী’ মন্তব্য, ছেলের ওপর হামলা

লন্ডনে হামলার শিকার হয়েছেন এক বাংলাদেশি তরুণ। তরুণের ভাষ্য, তাঁর হিজাব পরা মা...

রাকসু নির্বাচনে কার কী প্যানেল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-রাকসু নির্বাচনের এ পর্যন্ত নয়টি প্...

হাত না মেলানো : ভারতের ব্যাখ্যা, পাকিস্তানের প্রতিবাদ

আগা সালমান-শাহিন আফ্রিদিরা হয়তো সেটা ভেবেই মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন...

বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেছে তিস্তার পানি

টানা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি আব...

গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে ইসরায়েল: জাতিসংঘের তদন্ত কমিশন

গাজার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের একটি স্...

ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নতুন নির্দেশনা

ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা আরও সুশৃঙ্খল করতে সরকারি হাসপাতালগুলোকে নতুন নির্দেশনা...

ক্রীড়া পরিদপ্তরে দুদকের অভিযান

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ক্রীড়া পরিদপ্তরের বার্ষিক ক্রীড়া কর্মসূচি প...

এক লাফে ট্যারিফ বাড়ল গড়ে ৪০ শতাংশ

বন্দর ব্যবহারকারীদের আপত্তি উপেক্ষা করেই নতুন ট্যারিফের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়...

বগুড়ায় মা ও ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা

বগুড়ার শিবগঞ্জে এক নারী ও তার কলেজপড়ুয়া ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা