রাজনীতির মাঠে সব কূল হারিয়ে নয়া কৌশলে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ।
সাম্প্রতিক সার্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কয়েকজন বলেন, পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে- আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপদে ফেলতে প্রতিটি আন্দোলনকে বেছে নিচ্ছে। আন্দোলনের যৌক্তিকতা থাকুক বা না থাকুক তারা সেখানে কৌশলে তাদের লোকজনকে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। উদ্দেশ্য-সরকারবিরোধী বড় ধরনের বিক্ষোভের প্লট তৈরি করা। আর এক্ষেত্রে পলাতক আওয়ামী লীগের অন্যতম টার্গেট ছাত্রদের মতো স্পর্শকাতর আন্দোলনকে পুঁজি করা। অন্তর্বর্তী সরকারের গত আট মাসের অসংখ্য আন্দোলনের গতিপথ পর্যালোচনায় এমন দৃশ্যপট বারবার ধরা পড়ছে। এজন্য তারা মনে করছেন, যেখানে আন্দোলন সেখানেই ফ্যাসিবাদের গোপন ছায়া। এজন্য সরকারসহ দেশপ্রেমিক সবাইকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
বিশ্লেষকরা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল-ভ্রান্তি থাকতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ সরকার ব্যর্থ হওয়া মানেই গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়া। এ কারণে আন্দোলনের নামে মহলবিশেষ যেন লাশ ফেলার রাজনীতিসহ নাশকতামূলক কিছু ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে সরকারকেও সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দেশকে নির্বাচনের পথে এগিয়ে নিতে সব পক্ষকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
তারা মনে করেন, দেশকে অচল করা এবং রাজনীতি-অর্থনীতিসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি অশান্ত করে তুলতে নিত্যনতুন কৌশল বেছে নিচ্ছে এই ‘স্যাবোটাজ লীগ’। নিজেদের অপকৌশল বাস্তবায়নে সর্বত্র ষড়যন্ত্রের বীজ বুনতে এরা কখনো আনসার, কখনো অটোরিকশা, কখনো বা শিক্ষক ও শ্রমিকসহ নানা গ্রুপের ওপর ভর করছে। তবে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে দফায় দফায় বেশি চেষ্টা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ঢুকে যৌক্তিক আন্দোলনের গতিপথ ভিন্নদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার।
এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বৃহস্পতিবার বলেন, আওয়ামী লীগ ও তাদের সব সংগঠনের কার্যক্রম ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তারা এখন নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে নানাভাবে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড চালাবে, দেশকে অচল করা এবং দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি অশান্ত করে তুলতে নিত্যনতুন কৌশল নেবে-এটাই স্বাভাবিক।
সাইফুল হক আরও বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও বিদেশের মাটিতে বসে তিনি দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করে যাচ্ছেন। নানা উপায়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাতে ষড়যন্ত্র করছেন। তার নির্দেশে একই কাজ করে যাচ্ছে দলের লোকজন। এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে এবং বলা যায় আরো বেড়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকদিন ধরে ঢাকার রাজপথ ফের অশান্ত এবং উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এর পেছনে মূলত পতিত আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদের খবর মিলছে। পর্দার আড়ালে থেকে অর্থ-অস্ত্র-লোকবল সরবরাহসহ নানাভাবে রসদ জোগাচ্ছে এই দলটি। বিশেষ করে দলীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নানা কায়দায় উসকে দিচ্ছে আন্দোলনের মাঠ। এদের মূল লক্ষ্য নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, বিব্রত করা, ব্যর্থ প্রমাণিত করা এবং স্যাবোটাজ করে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। এছাড়া মব-জাস্টিসের নামেও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। দাবি আদায়ের নামে সরকারের ওপর একের পর এক খরচের বোঝা চাপিয়ে দিতেও মহলবিশেষ পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে।
সূত্র জানায়, আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিতসহ তিন দফা দাবিতে জগন্নাথ বিশবিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের কঠোর আন্দোলন বুধবার থেকে অব্যাহত আছে। এর মধ্যে প্রথমদিন ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীরা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় না বসে হঠাৎ এভাবে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে। তবে বুধবার রাতে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনা ভিন্ন কিছুর বার্তা দিচ্ছে। এ হামলার জন্য অনেকে একটি দলের ছাত্র সংগঠনের দিকে আঙুল তুলছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন, যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার বেকায়দায় পড়লে সবচেয়ে বেশি খুশি হওয়ার কথা আওয়ামী লীগের, সেহেতু যে কোনো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের এ বিষয়টিকে মাথায় নিয়ে কর্মসূচি দিতে হবে। নানাভাবে ফিল্টারিং করে আন্দোলন কর্মসূচি চালাতে হবে। এছাড়া পুলিশের বিষয়েও সরকারের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদস্যদের মাঠে নামানোর আগে তাদের প্রত্যেকের বিষয়ে ভালো করে খোঁজখবর নিতে হবে। কেননা, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ পুলিশ সদস্য তাদের দলের অনুসারী।
এ প্রসঙ্গে গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বৃহস্পতিবার বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চেয়ে আসছে। কিন্তু নির্বাচন কবে হবে, সংস্কার কবে শেষ করে-তা এখনো অস্পষ্ট। এর সুযোগ নিচ্ছে পরাজিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ। এছাড়াও যারা এক সময় ঐক্যবদ্ধভাবে শেখ হাসিনার বিদায় ঘণ্টা বাজিয়েছে, তারাও এখন নানা ভাগে বিভক্ত, তাদের মধ্যে বিরোধের বিষয়টিও স্পষ্ট। যার সুযোগ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ফের ঊর্ধ্বগতি, মিয়ানমারকে করিডর দেওয়ার অভিযোগসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে দেশে এক ধরনের ধোঁয়াটে, গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। ফলে এ সুযোগ তো আওয়ামী লীগ নিতে চাইবেই। তারা ছদ্মবেশে বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে পড়ছে। এজন্য রাজপথের বেশির ভাগ আন্দোলন হঠাৎ করে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর যখন জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ কঠোরহস্তে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সেটিকে বাধাগ্রস্ত করতে একের পর এক মাঠে দাবির মিছিল নামে। অনেকে মনে করেন, এসব দাবি-দাওয়া কর্মসূচিতে পেছন থেকে ইন্ধন জুগিয়েছে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা। দাবি আদায়ের নামে শুরুতেই আনসার ও ভিডিপির সদস্যদের মাঠে নামানো হয়। যাদের বেশির ভাগই ছিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মী এবং কয়েকটি বিশেষ জেলার বাসিন্দা। এরপর একই উদ্দেশ্যে প্যাডেলচালিত রিকশাচালক, অটোরিকশাচালক, সিএনজিচালক, শ্রমিক-কর্মচারী, শিক্ষক, ডাক্তার, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন ব্যানারে একের পর এক সংগঠন দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামে। এদের মূল চাওয়া ছিল শুরুতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে বড় ধরনের ধাক্কা দেওয়া। এরপর অর্থনৈতিকভাবে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে সরকারকে দিশেহারা করে তোলা।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর নতুন করে ষড়যন্ত্র থিউরি নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। রাজপথে থাকা বিভিন্ন আন্দোলনকে পুঁজি করে তারা ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করতে চান। এক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নানা অ্যাপস ব্যবহার করা হচ্ছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে হরতাল, মশাল মিছিল, লিফলেট বিতরণের মতো কর্মসূচিও দেওয়া হয়। এভাবে আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীদের উসকে দিয়ে স্যাবোটাজ প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে মরিয়া দলটির দেশি-বিদেশি চক্রটি।
আমারবাঙলা/ইউকে