গায়ক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিনোদনজগতে আসেন যাহের আলভী। পরে অভিনয়েই খুঁজে পান নিজের জায়গা। ছোট পর্দায় নিজেকে প্রমাণ করে আছেন বড় পর্দার অপেক্ষায়। এই অভিনেতার গল্প শুনব আজ...
তখন সন্ধ্যা নেমেছে। খিলগাঁও তালতলা মার্কেট এলাকায় মানুষের ভিড়। হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো লাইভ লোকেশন ধরে খুঁজতে থাকি জাহের আলভীকে। মার্কেটের পাশের এক গলিতে ঢুকতেই একজন এগিয়ে নিতে এলেন। তাঁর সঙ্গে গলির শেষে ছোট্ট একটা বাড়িতে ঢুকে দেখা মেলে অভিনেতার। মনোযোগ দিয়ে নিজের নির্দেশিত নাটকের সম্পাদনার কাজ তদারক করছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই চলল আড্ডা। আলাপের শুরুতে আলভী ফিরে গিয়েছিলেন কৈশোর, সংগ্রামের দিনগুলোতে। উঠে এল প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি, আক্ষেপ থেকে নতুন স্বপ্ন।
গায়ক হতে এসে নায়ক
গানের গলা ছিল। কৈশোরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় গলা ছেড়ে গাইতেন। পারিবারিক অনুষ্ঠানে গানের অনুরোধ করতেন সবাই। ২০১৩ সালে আলভী নাম লেখান রিয়েলিটি শো চ্যানেল আই সেরা কণ্ঠে। কয়েক ধাপ পেরিয়ে থামেন সেরা পনেরোতে। প্রচণ্ড মন খারাপের সঙ্গে জেদ চাপে নিজের মধ্যে।
ওই বছরই আরেক রিয়েলিটি শো ‘ফেয়ার অ্যান্ড হ্যান্ডসাম দ্য আল্টিমেট ম্যান’–এ রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চলছিল। এক আত্মীয় পরামর্শ দিলেন, ‘দেখতেশুনতে তো তুমি ভালো। এখানে একটা সুযোগ নিয়ে দেখবে নাকি।’ রেজিস্ট্রেশন করেন আলভী। দ্বিতীয় রানারআপ হয়ে শেষ করেন প্রতিযোগিতা। আলভী বলেন, ‘ঢাকা বিভাগের অডিশন রাউন্ড দিয়ে প্রতিযোগিতার শুরু। প্রথম দিন সেখানেই পৌঁছে আত্মবিশ্বাস অনেক কমে যায়। দেখি, ঢাকা শহরের সব হ্যান্ডসাম ছেলে এখানে চলে আসছে! এক ধাপ, এক ধাপ পেরিয়ে গ্র্যান্ড ফিনালে পৌঁছাই। জমজমাট লড়াই শেষে দ্বিতীয় রানারআপ হিসেবে শেষ করি।’
ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে বিনোদন–দুনিয়ায়
স্কুল–কলেজে পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলেন আলভী। বাবা-মায়ের ইচ্ছা, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগে। কিন্তু অভিনেতা হওয়ার তীব্র বাসনায় শেষ পর্যন্ত মন টেকেনি সেখানে। বাবা-মায়ের এত মন খারাপ আর অভিমান হয়েছিল, কয়েক দিন কেউ কথা বলেননি আলভীর সঙ্গে। ‘গান করতাম, আর টুকটাক মডেলিং করতাম। এরপর পুরোপুরি অভিনয়ে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলাম। তখন বিভিন্ন জায়গায় কাজের জন্য অডিশনে যেতাম। কাজ করার চেয়ে খুঁজতেই একটা ভালো সময় চলে যেত। এদিকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনার ভালোই চাপ। সব মিলিয়ে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। পড়াশোনায় যে আমি খারাপ, তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজাল্টও ভালোই করছিলাম। কিন্তু কেন জানি মজা পাচ্ছিলাম না, ভেতরের একটা আত্মতৃপ্তি আছে না? তাই ছেড়ে দিই। এরপর ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করি।’ বলছিলেন আলভী।
হাল ছেড়ো না
রিয়েলিটি শোতে দ্বিতীয় রানারআপ হওয়ার পরদিন সংবাদমাধ্যম থেকে টেলিভিশন-সবখানেই আলোচনায় আলভী। অন্য অনেকের মতো তিনিও তখন ভেবেছিলেন, ভালো কাজের প্রস্তাব আসতে থাকবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তা ভুল প্রমাণিত হতে থাকে। আলভী কাজের জন্য ছুটতে লাগলেন নির্মাতাদের কাছে। ছোট ছোট চরিত্রে সুযোগ পেতে থাকেন, তবে তাতেই নিজেকে প্রমাণ করার দৃঢ় মানসিকতা ছিল তাঁর। হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো মানসিক চাপ নিজের মধ্যে চললেও নিজেকে বারবার অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি। সংগ্রামের সে সময় নিয়ে আলভী বলেন, ‘দ্বিতীয় রানারআপ হওয়ার আগে তো একটা সংগ্রাম ছিল, কিন্তু এটা পার হয়ে দেখি, চারপাশে অন্ধকার। আয়োজকেরা চ্যাম্পিয়নকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। যদিও এটাই হওয়ার কথা। আবার তাঁরা যে আমাকে সমর্থন করেননি, তা–ও নয়। ভালো সুযোগ বলে না? এটা যেন আসছিল না। রাত জেগে চিন্তা করতাম, কী হবে সামনে। অনেক সময় ভেঙে পড়তাম, আবার নিজেকেই নিজে বোঝাতাম। তোমাকে দিয়ে হবে আলভী, হাল ছেড়ো না।’
ইউটিউব দিয়ে আলোচনায়
কয়েক বছর ধরে যাঁদের নাটক ইউটিউবে মিলিয়ন ট্রেন্ডে থাকে, তাঁদের মধ্যে যাহের আলভী অন্যতম। এই অভিনেতার তিন শতাধিক নাটক ইউটিউবে মিলিয়ন ভিউ পেরিয়েছে। আলভী মনে করেন, সাধারণ মানুষের ভালোবাসা তাঁকে আজ এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘কাক, ‘ভালোবাসা এমনই’, ‘কপাল’, ‘বেঈমান’ ও ‘অসহায়ের মতো ভালোবাসি’। অভিনেতা বলেন, ‘ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম না থাকলে এ জায়গায় থাকতাম কি না, জানি না। শুধু আমি কেন, অনেকেই এখান থেকে হারিয়ে যেতেন। এখানে আমার কোনো গডফাদার নেই, আমি কোনো সিন্ডিকেটে নেই। আমিই আমার গডফাদার। তবে অনেক মানুষের অবদান আমার ক্যারিয়ারে আছে। তাঁরা এ ভালোবাসা, সাহস ও সমর্থন না জোগালে সত্যিই এ অবস্থানে আসতে পারতাম না।’
প্রযোজনা ও নির্মাণে ব্যস্ততা
অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনাতেও নাম লিখিয়েছেন যাহের আলভী। কিং প্রোডাকশনসের ব্যানারে প্রযোজনা করেছেন বেশ কটি নাটক। এর মধ্যে ‘জানোয়ার থ্রি’, ‘তুমুল বৃষ্টি’, ‘জঙ্গলে বিয়ে’, ‘ভটভটি’ উল্লেখযোগ্য। প্রযোজনার সঙ্গে পরিচালনাতেও হাত পাকাচ্ছেন আলভী। তাঁর পরিচালিত ভটভটি ইউটিউবে মিলিয়ন ভিউ পার করেছে। মুক্তির অপেক্ষায় আছে তাঁর পরিচালিত ‘টান’ ও ‘ইউ মি অ্যান্ড মালায়শিয়া’ নাটক দুটি। আলভী বলেন, ‘নির্মাণের ইচ্ছে ছিল প্রথম থেকেই। তবে সময় নিয়েছি। প্রথমে প্রযোজনা শুরু করি। এখন নির্মাণেও সময় দিচ্ছি। আরও বড় পরিসরে প্রযোজনা করার ইচ্ছা আছে। চেষ্টা করছি, দেখা যাক সময় কোন দিকে নিয়ে যায়।’
প্রেরণা কে
অবসর সময় সিনেমা দেখে কাটান যাহের আলভী। হলিউডের নতুন ছবির সঙ্গে কালজয়ী ছবিগুলো বারবার দেখা হয়। আর ইদানীং দক্ষিণ ভারতের মালয়ালম ছবি দেখা হচ্ছে। মঞ্চ কিংবা অভিনয়ের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে না আসা আলভীর কাছে সিনেমা দেখাই স্কুলিং। অভিনয়ের আদর্শ বাংলাদেশের প্রয়াত অভিনেতা আহমেদ রুবেল ও হলিউডের জনি ডেপ।
বড় পর্দার অপেক্ষা
হিরো হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই নাম লিখিয়েছিলেন রিয়েলিটি শোতে। তাই এখনো আলভীর স্বপ্নের জায়গা বড় পর্দা। কয়েকটি সিনেমার আলাপ প্রাথমিক পর্যায়ে চলছে। সব ঠিক হলেই জানাবেন সবাইকে।
আমারবাঙলা/জিজি