মার্কিন সিনেটের ফরেন রিলেশনস কমিটির এক শুনানিতে সিরিয়ার বিভাজিত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সিনেটর জেমস রিশে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি বলেন, সিরিয়ার মানচিত্র দেখলে মনে হয় যেন একটি সমতল রুবিক্স কিউব—এতটাই জটিল এর অভ্যন্তরীণ বিভাজন। তার ভাষায়, ‘আমরা মূলত দেশের পশ্চিম অংশের শাসনব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছি।’
এই মন্তব্যটি তিনি করেন আলভী সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় সংঘটিত গণহত্যার কয়েক সপ্তাহ আগে। রিশে আরও বলেন, ‘আমার ধারণা, আমাদের প্রথম মনোযোগ দেওয়া উচিত দেশের পশ্চিম অংশে। কারণ, যদি এই অংশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না রাখা যায়, তাহলে পুরো দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’
শুনানিতে ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাইকেল সিং বলেন, ‘আমরা পশ্চিম সিরিয়ার পরিস্থিতির দিকে মনোযোগ দিতে পারি। সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের সুযোগ তৈরি করাও আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’
সিরিয়ার ‘পশ্চিমাঞ্চল’ নিয়ে মার্কিন সিনেটে আলোচনার পর বাস্তবতা এখন আর ধোঁয়াশায় নয়, বরং এক কাঠামোবদ্ধ বহু-মুখী সামরিক অভিযানে রূপ নিয়েছে এই প্রকল্প। সাম্প্রদায়িক বিভাজন উসকে দিয়ে এবং বিদেশি সেনা সমন্বয়ের মাধ্যমে সিরিয়া–লেবানন সীমান্তে নতুন একটি বাস্তবতা তৈরির প্রচেষ্টা চলছে। পুরো অভিযানের পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান করছে ইসরায়েল।
এই ‘পশ্চিম সিরিয়া’ প্রকল্পের আওতা লেবাননের অভ্যন্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। পরিকল্পনায় রয়েছে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান এবং লেবাননের উপকূলবর্তী এলাকায় সিরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর পুনঃমোতায়েন। ইসরায়েলের উগ্রপন্থী সরকার এ পরিকল্পনার অর্থদাতা ও মূল স্থপতি। সামরিকভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইসরায়েলি সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াল জামিরা এবং ক্যাপ্টেন রবার্ট।
গণমাধ্যমে একে খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের রক্ষার ‘মিশন’ হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও, প্রকৃত লক্ষ্য হলো চার্চ, মঠ ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোয় হামলা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানো এবং ইসরায়েলি হস্তক্ষেপের পথ সুগম করা।
সিরিয়ার নিরাপত্তাবাহিনী জানিয়েছে, এরইমধ্যে সিরিয়ার বন্দরনগরী তারতুসে হামলার প্রস্তুতিকালে একটি সেলকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির নিরাপত্তাবাহিনী। মার এলিয়াস ম্যারোনাইট চার্চকে টার্গেট করেছিল সেলটি। তারতুসের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান আবদেলাল মোহাম্মাদ আবদেলাল জানান, ‘এই অভিযান ছিল উচ্চ-স্তরের এবং নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত।’
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, এটি খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে অস্থির করার এবং বাইরের হস্তক্ষেপকে বৈধ মোড়কে আনার একটি কৌশল। এর দুই দিন আগে গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছিল ‘ক্রিশ্চিয়ান মিলিটারি কাউন্সিল’ গঠন হয়েছে এলিয়াস সাব নামে একজনের নেতৃত্বে। যদিও, এখন পর্যন্ত এই নামে কোনো ব্যক্তির পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে এ ধরনে সামরিক ঘোষণার সঙ্গে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে উত্তেজনার বৃদ্ধিকে অনেকেই কৌশলগত প্রক্রিয়ার অংশ বলে মনে করছেন।
গত ৫ আগস্ট ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সম্পর্ক ও কৌশলগত পরামর্শক সংস্থা টাইগার হিল পার্টনার্স ঘোষণা করে যে, তারা ‘ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট অব দ্য ওয়েস্টার্ন সিরিয়া’র অফিশিয়াল প্রতিনিধি হবে। টাইগার হিলের এক বছরের চুক্তির মূল্য প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার। তারা খ্রিষ্টান, দ্রুজ, আলভী, কুর্দ এবং ‘মধ্যমপন্থী সুন্নি’দের পক্ষে কাজ করবে এবং মার্কিন নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তনে সহায়তা করবে।
এরপর, জুলাইয়ের শেষ দিকে, ‘ম্যান অব লাইট—সারায়া আল-জাওয়াদ’ নামে উপকূলীয় এক বিদ্রোহী গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করে। তাদের বিবৃতিতে সিরিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবু মুহাম্মাদ আল-জোলানি ওরফে আহমদ আল-শারা, কাতারের আমির ও তুরস্কের প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করা হয়। পাশাপাশি মিসর, ইসরায়েলি সাংবাদিক এডি কোহেন এবং প্রবাসী আলভী, দ্রুজ ও খ্রিষ্টান নেতাদের প্রতি ধন্যবাদ জানানো হয়।
১৭ জুলাই ইসরায়েলের তেল আভিভা হোটেলে দেশটির সরকারি কর্মকর্তা, সিরিয়ান আলভী ও দ্রুজ প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে নির্বাসিত সাত আলভী ও দ্রুজ নেতা। দ্বিতীয় বৈঠক হয় ২১–২২ জুলাই, সারায়া আল-জাওয়াদ আত্মপ্রকাশের ঠিক আগে।
এরপর, গত ৬ আগস্ট আরব বিষয়ক ইসরায়েলি সাংবাদিক এডি কোহেন ঘোষণা করেন যে যুক্তরাষ্ট্রে আলভী-দ্রুজ জোট গঠনের প্রস্তুতি চলছে। একই সময়ে, একটি ফাঁস হওয়া অডিওতে বলতে শোনা যায়, ধর্মনিরপেক্ষ এক সিরিয়া প্রবাসী নেটওয়ার্ক এবং ইসরায়েলি মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে। এতে ২ হাজার ৫০০ বিদেশি যোদ্ধাকে গোপনে সিরিয়ায় প্রেরণ করার পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
যদিও এই প্রকল্প দ্রুত এগোচ্ছে, তবে দেশীয় এবং বাইরের অনেক পক্ষ তা ব্যর্থ করার চেষ্টায় রত। ইতিমধ্যে সাফিতা চার্চে হামলা এবং দামেস্কে বড় ধরনের বোমা হামলা প্রতিহত করা হয়েছে।
এক আঞ্চলিক নিরাপত্তা সূত্র দ্য ক্রেডলকে বলেছেন, ‘ইসরায়েল সিরিয়ার সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিভাজনকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ও সামরিক সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এর লক্ষ্য সিরিয়াকে বিভাজিত করা এবং দুইটি কৌশলগত করিডর খোলা—একটি পূর্ব দিকে সুয়েইদা থেকে হাসাকা পর্যন্ত এবং অপরটি পশ্চিম দিকে সিরিয়ার উপকূল থেকে আফ্রিন পর্যন্ত।’
স্বাধীন ‘পশ্চিম সিরিয়া’ প্রকল্প হয়তো অন্ধকারে থেকেই যেতে পারে বা পুরোপুরি প্রকাশ পেতে পারে, তবে এর গতিপথ স্পষ্ট—এটি সিরিয়ার ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করছে, সংখ্যালঘু সুরক্ষার আড়ালে বিদেশি সমর্থিত মিলিশিয়া ও রাজনৈতিক ফ্রন্টের মাধ্যমে। দামেস্ক, বৈরুত এবং এই বিস্তৃত অঞ্চলের জন্য এটি কোনো সুদূর হুমকি নয়, বরং একটি সক্রিয় অভিযান যা ইতিমধ্যে মানচিত্রকে বাইরের শক্তির সুবিধায় পুনর্গঠনের কাজ করে চলেছে।
তথ্যসূত্র: দ্য ক্রেডল, মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক অনুসন্ধানী ও বিশ্লেষণধর্মী সংবাদমাধ্যম
আমারবাঙলা/এফএইচ