বর্তমান বিশ্বে দ্রুত শিল্পায়ন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাম্পিং গ্রাউন্ডে বর্জ্যের পাহাড় জমা হচ্ছে, যা পরিবেশের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একই সঙ্গে, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে। এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় 'রৈখিক অর্থনীতি' (Linear Economy)—অর্থাৎ 'ব্যবহার ও ফেলে দেওয়া'র মডেলের পরিবর্তে 'চক্রাকার অর্থনীতি' (Circular Economy) বা 'পুনঃব্যবহার ও পুনর্ব্যবহার' মডেলের দিকে ঝুঁকে পড়া এখন সময়ের দাবি। এই নতুন মডেল শুধু পরিবেশ রক্ষা নয়, বর্জ্যকে একটি মূল্যবান সম্পদে রূপান্তরিত করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
ঐতিহ্যগতভাবে, বর্জ্যকে একটি মূল্যহীন পদার্থ হিসেবে গণ্য করা হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু চক্রাকার অর্থনীতিতে বর্জ্যকে নতুন পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে দেখা হয়। এটি কেবল একটি পরিবেশগত ধারণা নয়, বরং একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক মডেল। এর মূল লক্ষ্য হলো সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে বর্জ্যকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা। এই দর্শনটি তিনটি মৌলিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত: পণ্য এমনভাবে ডিজাইন করা যাতে তা বর্জ্য ও দূষণমুক্ত হয়, পণ্য ও কাঁচামালকে বারবার ব্যবহার করে তাদের জীবনকাল বাড়ানো, এবং প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করা।
প্রতিদিনের জীবনে চক্রাকার অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে তা আমরা সহজেই দেখতে পাই। বাজার থেকে কেনা প্লাস্টিক বোতল বা প্যাকেট ফেলে না দিয়ে পুনঃব্যবহার করলে এর জীবনচক্র বাড়ে। ভাঙা আসবাবপত্র মেরামত করে আবার ব্যবহার করলে নতুন কাঠ কাটার প্রয়োজন হয় না। পুরোনো কাপড় পুনঃব্যবহার করে নতুন পণ্য তৈরি করা যায়। এমনকি বাড়ির জৈব বর্জ্য আলাদা করে সার বানালে তা কৃষিতে কাজে লাগে। এভাবেই দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট অভ্যাস চক্রাকার অর্থনীতিকে বাস্তবে রূপ দেয়।
বর্জ্যকে নতুন কাঁচামাল ও সম্পদে রূপান্তরিত করলে শুধু উৎপাদন খরচই কমে না, বরং নতুন কর্মসংস্থান এবং ব্যবসার সুযোগ তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে নতুন প্লাস্টিক পণ্য তৈরি, পুরোনো ইলেকট্রনিক্স থেকে মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধার, বা জৈব বর্জ্য থেকে জৈব সার ও বায়োগ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব। একইভাবে ব্যাটারি রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে সীসা, লিথিয়াম এবং নিকেলের মতো মূল্যবান ধাতু পুনরুদ্ধার করা যায়, যা নতুন ব্যাটারি, সোলার এনার্জি স্টোরেজ বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। এতে পরিবেশ দূষণ কমে, আমদানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস পায় এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়।
বাংলাদেশে দ্রুত বাড়তে থাকা শহুরে বর্জ্যকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে তা দেশের অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। বর্জ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, এবং রিসাইক্লিং শিল্পে বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে ছোট থেকে বড় সব ধরনের উদ্যোগ গড়ে তোলা সম্ভব। পুনর্ব্যবহৃত পণ্য, যেমন গার্মেন্টস শিল্পে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুতা বা প্লাস্টিক দানা, আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।
চক্রাকার অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পণ্যের জীবনচক্র। ছোট জীবনচক্রের (short life cycle) পণ্য যেমন প্লাস্টিক বোতল দ্রুত রিসাইক্লিং চেইনে ফেরাতে হবে। আর দীর্ঘ জীবনচক্রের (long life cycle) পণ্য যেমন আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স বা যানবাহন মেরামত, পুনঃউৎপাদন বা আপগ্রেড করে বারবার ব্যবহার করা সম্ভব।
চক্রাকার অর্থনীতি প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবেশকে আরও টেকসই করে তুলবে। দূষণ কমবে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সহজ হবে, এবং বৈদেশিক আমদানির ওপর চাপ কমে আসবে। একই সঙ্গে উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে।
তবে চক্রাকার অর্থনীতির পথে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, বর্জ্য পৃথকীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি, এবং বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা। তাই প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগ। সরকারকে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে এ খাতকে এগিয়ে নিতে হবে।
রিসাইক্লিং থেকে রাজস্ব আদায় কোনো কল্পনা নয়, বরং একটি বাস্তব অর্থনৈতিক মডেল, যা বাংলাদেশকে টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে পারে। চক্রাকার অর্থনীতির সফল বাস্তবায়ন শুধু অর্থনৈতিক লাভই দেবে না, বরং একটি পরিচ্ছন্ন, দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ
আমারবাঙলা/এফএইচ