জাতীয়
সারাদেশে ১৭৩০ মামলা

তদন্ত এগিয়ে নিতে সাত চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট দুপুরে ভারতে পালানোর পর দেশজুড়ে বের হয় বিজয় মিছিল। রাজধানীর বাড্ডায় মিছিলে অংশ নেন আল আমিন নামে এক যুবক। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধলে আল আমিনের শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে যায় গুলি। প্রাণ হারান তিনি।

এ ঘটনায় আল আমিনের স্ত্রী, বাবা কিংবা ভাইকে না জানিয়েই ঘটনাস্থলের আওতার বাইরের আলাদা থানায় দুটি মামলা হয়। ১০০ ফুট এলাকায় ঘটনাস্থল উল্লেখ করে ভাটারা থানায় মামলা করেন তাঁর চাচা রহমান মাল এবং পশ্চিম রামপুরায় ঘটনাস্থল দেখিয়ে হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন অচেনা এক ব্যক্তি। আল আমিন খুন হন বাড্ডা থানা এলাকায়। অথচ অন্য দুটি স্থানকে ঘটনাস্থল দেখিয়ে দুজন মামলা করে দেন! এতে আসামি করা হয় ৩৮২ জনকে। ফলে মামলার তদন্ত নিয়ে বিপাকে পড়ে সংশ্লিষ্টরা।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে অবশ্যই ঘটনাস্থল সুনির্দিষ্ট করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে এসব মামলায় সঠিক বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া সাক্ষীসহ অন্য উপাদনও গুরুত্বপূর্ণ।

পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (অপরাধ ও অপস) খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, অধিকাংশ মামলা দেরিতে হয়েছে। এতে অনেক ক্ষেত্রে আলামত নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া অনেক লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন হয়েছে। ঢাকার মানুষ সবাই সবাইকে চেনে না। এ কারণে হতাহতের ঘটনায় জড়িত সঠিক লোককে বের করা কঠিন হয়ে পড়ছে। মামলার তদন্তে এসব বড় চ্যালেঞ্জ। তবে মামলার নিখুঁত তদন্তে আমরা কাজ করছি। পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে নির্ভুল অভিযোগপত্র দেওয়া হচ্ছে।

ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো বলেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষী ফৌজদারি মামলার প্রমাণের মূল ভিত্তি। এগুলোর ত্রুটি থাকলে রাষ্ট্রপক্ষ মামলা নিয়ে বিপদে পড়ে।

সাত চ্যালেঞ্জ

মামলার তদন্ত-তদারকি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের মামলাগুলো বিশেষ করে হত্যা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তাদের অন্তত সাত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

এর মধ্যে রয়েছে– বেশির ভাগ মামলায় ঘটনাস্থল সুনির্দিষ্ট না থাকা। ঘটনাস্থল এজাহারের উল্লেখিত জায়গার সঙ্গে বাস্তবে মিল নেই। শহীদ গুলিবিদ্ধ বা হামলার শিকার হয়েছেন এক স্থানে, মামলায় উল্লেখ করা আছে আরেক স্থান, এজাহারে ভুল বর্ণনা, একই ঘটনায় একাধিক মামলা, প্রায় প্রতিটি মামলায় ২০০-৩০০ আসামি। ৪০০ আসামিও রয়েছে কোনো মামলায়। এত আসামির মধ্যে যাচাই-বাছাই করে জড়িত ব্যক্তি শনাক্ত কঠিন। ব্যবসায়িক, রাজনীতি ও ব্যক্তিস্বার্থে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে আসামি করা হয়েছে।

এমনকি যিনি কখনও ঢাকায় আসেননি, তাঁকেও রাজধানীর থানায় করা মামলায় আসামি করা হয়েছে; কিছু মামলায় বাদী ভিকটিমকে চেনেন না। এ ছাড়া তদন্তের সময় কিছু মামলার বাদীকে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ছে। প্রায় ৯০ শতাংশ শহীদের ময়নাতদন্ত হয়নি। এসব লাশ তোলার জন্য আদালত থেকে অনুমতি নেওয়ার পর অনেক পরিবারের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে কীভাবে মারা গেছে, তা জানা যাচ্ছে না। ১৮ থেকে ২০ জুলাই শহীদদের লাশ সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত হলেও ৪ ও ৫ আগস্টে শহীদদের ময়নাতদন্ত হয়নি। এমনকি সুরতহাল প্রতিবেদনও নেই। এসব কার্যক্রম পরিচালনার মতো পুলিশ ছিল না।

আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বাচারে পুলিশের গুলি, ৫ আগস্টের দুপুরের পর বিভিন্ন থানায় হামলা–এসব কারণে পুলিশ পালিয়ে যাওয়ায় দেশের সব থানায় কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছিল। ফলে লাশ স্বজনরা নিজেদের মতো নিয়ে গিয়ে দাফন করেন। অনেক লাশের হাসপাতালের মৃত্যু সনদও নেই; কার গুলিতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। বেশির ভাগ ঘটনার সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না।

ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে যেসব মামলায় গুরুত্বপূর্ণ, তা সংগ্রহ করাও চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। অনেক ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং পরিচয় না মেলায় বেওয়ারিশ হিসেবে অনেকের লাশ দাফন করা হয়েছে। পরিচয় শনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের হত্যার ঘটনায় মামলা ও তদন্ত করাও চ্যালেঞ্জ। এসব কারণে তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারছেন না তদন্ত কর্মকর্তারা।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা

অবশ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এসব মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য পুলিশ সদরদপ্তর বিশেষ মনিটরিং দল গঠন করেছে। এ ছাড়া ডিএমপি ও গাজীপুরে একটি করে এবং দেশের আট বিভাগে আটটি ‘মেন্টরিং অ্যান্ড মনিটরিং’ দল গঠন করা হয়েছে। এসব দল মামলাগুলো বিশ্লেষণ করছে। তারা তদন্তসংশ্লিষ্টদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। তদন্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা ধরিয়ে দিয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের। এ ছাড়া আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে ত্রুটি শনাক্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার এবং পিপির পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। কোনো ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করে নেওয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির এক মামলা তদারক কর্মকর্তা জানান, তদন্তে নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও নিখুঁত প্রতিবেদন তৈরি করতে সেগুলো উত্তরণের চেষ্টা চলছে। একই ঘটনায় একাধিক মামলা হলে আদালতের নির্দেশে একটি মামলার তদন্ত করে পুলিশ প্রতিবেদন দেওয়া হবে। বাকি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশক্রমে মামলাগুলো একজন কর্মকর্তাকে দিয়েও তদন্ত করানো যায়। ঘটনাস্থল আলাদা থাকলে আগের মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে নতুন করে নিহতের স্বজনকে বাদী করিয়ে মামলা নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে স্বজন বাদী হতে রাজি না হলে, পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যেসব লাশ উত্তোলন করা যাচ্ছে না, সেগুলোর ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক সাক্ষী হিসেবে যারা লাশ গোসল করিয়েছেন, জানাজা পড়িয়েছেন, দাফনে অংশ নিয়েছেন–তাদের জবানবন্দি নেওয়া হচ্ছে।

একটি মামলায় একাধিক আসামির ক্ষেত্রে আরেক কর্মকর্তা বলেন, জুলাই আন্দোলনে কারা বিপক্ষে ছিল, কারা আন্দোলনকারীকে প্রতিহত করতে উস্কানি দিয়েছে, তা তো স্পষ্ট। হুকুমের আসামি করতে তেমন বেগ পেতে হবে না। এ বিষয়ক অনেক ফুটেজ রয়েছে। এ ছাড়া যেসব স্থানে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেই এলাকায় আন্দোলনবিরোধী এবং ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী শনাক্তের কাজ চলছে। সে সময় এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারা দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের নামও তদন্তে বেরিয়ে আসছে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, গেজেটভুক্ত অনেক শহীদ পরিবার এতদিন মামলা করেনি। তাদের অনেকেই গত মাসে মামলা করেছে। অনেক মামলার ভালো অগ্রগতি আছে। খুব শিগগির সেগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, একেক মামলায় আসামি অনেক। এ কারণে জড়িত প্রত্যেকের সংশ্লিষ্টতা তদন্তে উঠিয়ে আনা বেশ কঠিন।

আমারবাঙলা/জিজি

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ১৩৩ শিশু

গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশজুড়ে ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলন দমনে চালানো সহিংস অভি...

‘নির্যাতনে ছাত্রলীগের অংশীদার হতেন শিবিরের নেতা-কর্মীরা’

ইসলামী ছাত্রশিবির থেকে আসা কিছু নেতাকর্মী ছাত্রলীগের নির্যাতনে জড়িত ছিলেন বলে...

এনসিপি ‘কিংস পার্টি’, তাদের দুজন সরকারে : ইফতেখারুজ্জামান

গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত হওয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) &lsqu...

বিসিসিআইকে নির্লজ্জ বললেন প্রিয়াঙ্কা

অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে গেছে। এশিয়া কাপ ক্রিকেট যথাসময়েই শুরু হচ্ছে। রবিবার (৩ আগ...

ধারাবাহিক রান করার অভ্যাস জরুরি

ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করে জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ব্যর্থ হওয়া...

মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন প্ল্যাটফর্ম মঞ্চ ৭১ এর যাত্রা শুরু

সোমবার (৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ (বীর প্রতীক) ও মুক্তি...

আর্জেন্টিনার হয়ে ‘শেষ’ ম্যাচটা খেলতে পারবেন তো মেসি

লিগস কাপে গত পরশু নেকাক্সার বিপক্ষে চোটে পড়েন লিওনেল মেসি। বাধ্য হয়েই ১২ মিনি...

স্বরূপে ফিরল ইয়ামালের ‘সুপারম্যান’ দেয়ালচিত্র

বার্সেলোনা শহরের ভিলা দে গ্রাসিয়া অঞ্চলের প্লাসা জোয়ানিকে লামিনে ইয়ামালের দেয়...

সিডনিতে ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ প্রদর্শনী

সিডনিতে বাংলাদেশের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র এক বিশেষ...

সেই ‘রাশি’ এবার নতুন পরিচয়ে

একসময় দর্শকদের মন জয় করেছিলেন ‘রাশি’ হয়ে। টেলিভিশনের পর্দায় সেই আ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা