ছবি: সংগৃহীত
মতামত

হাদির কণ্ঠ থেমে গেলেও, তার আদর্শে নতুন প্রজন্মের ধ্বনি

রিয়াদুর রহমান পিনজু

ওসমান হাদির পুরো নাম শরিফ ওসমান বিন হাদি। তার জন্ম ৩০ জুন ১৯৯৩ সালে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায়। তার বাবা ছিলেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্থানীয় ইমাম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে হাদি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তিনি ছিলেন একজন বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ ও বক্তা। ওসমান হাদি জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গঠিত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। সম্প্রতি তিনি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৫ আগস্টের পর একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিলেন ওসমান হাদি। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস—ঘাতকরা শুধু হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি; হাদির জীবনের পথচলা থামাতে তাকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা।

গত ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারণাকালে জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। তার মাথায় গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের পর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত পৌনে ১০টার দিকে হাদি ইন্তেকাল করেন।

এরপর ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৫টা ৪৯ মিনিটের দিকে হাদির মরদেহ বহনকারী ফ্লাইটটি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। তার মরদেহের ময়নাতদন্ত ২০ ডিসেম্বর বেলা পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্ত শেষে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে মরদেহ নেওয়া হয়। সেখানে গোসলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় দুপুর আড়াইটার দিকে হাদির জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। হাদির জানাজার নামাজ পড়ান তার বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে ওসমান হাদিকে সমাহিত করা হয়।

তার এমন মৃত্যুতে সরকারসহ শোকে কাতর দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।

এ ঘটনায় শিক্ষক আব্দুল রহিম আমার বাঙলাকে বলেন, “ইন্টেরিম সরকারের কাছে একটাই দাবি—খুনিকে ফাঁসিতে ঝুলানো হোক।”

হাদির জানাজায় অংশগ্রহণ করা ক্যারি বি কুরিয়ারের কর্মী মোহন আমার বাঙলাকে বলেন, “জীবনে অনেক নেতার মৃত্যুসংবাদ শুনেছি, কিন্তু এরকম অনুভূতি কারও ব্যাপারেই হয়নি; নিস্তব্ধ হয়ে গেছি। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর আমরা একজন হাদিকে পেয়েছি, আরেকজন হাদি পেতে হয়তো আরও ৫৪ বছর অপেক্ষা করতে হবে।”

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস হাদির জানাজায় অংশ নিয়ে বলেন, “প্রিয় ওসমান হাদি, তোমাকে আমরা বিদায় দিতে আসিনি এখানে। তুমি আমাদের বুকের ভেতরে আছো এবং বাংলাদেশ যতদিন আছে, তুমি সব বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে।”

শরিফ ওসমান হাদির স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। তার মৃত্যুতে শনিবার (২০ ডিসেম্বর) একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়।

শরিফ ওসমান বিন হাদির শিক্ষাজীবন:

হাদির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু নলছিটির ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায়। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর তিনি ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং আলিম পরীক্ষা সম্পন্ন করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।

রাজনীতিতে উত্থান:

২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ওসমান হাদি সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং ঢাকার রামপুরা এলাকায় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন।

গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে হাদিকে অন্যতম ভূমিকায় দেখা যায়। ২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইনকিলাব মঞ্চ। সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল—সব আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন, যেখানে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও ন্যায়বিচার হবে প্রধান মূল্যবোধ।

ভোটের মাঠে হাদি:

তফসিল ঘোষণার আগেই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। তবে তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে নামেন এবং প্রচারণা শুরু করেন। তফসিল ঘোষণার দিন (১১ ডিসেম্বর) তিনি কাকরাইল ও সেগুনবাগিচা এলাকায় প্রচারণা চালান। সেদিন দুপুরে দুদক কার্যালয়ের সামনে ভোটারদের উদ্দেশে হ্যান্ড মাইকে বক্তব্য রাখেন হাদি।

পরদিন শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) বিজয়নগর কালভার্ট মোড়ে প্রচারণা চালান এবং গুলিবিদ্ধ হন। এটিই ছিল তার শেষ প্রচারণা।

শরিফ ওসমান বিন হাদি জুলাই শহিদদের অধিকার রক্ষা, আওয়ামী লীগ নিষেধাজ্ঞা আন্দোলন ও ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী সক্রিয় রাজনীতির জন্য আলোচনায় আসেন। তার এই নেতৃত্বের পথকে থামিয়ে দিতেই ঘাতকরা তাকে হত্যা করে। জাতি হারায় এক সাহসী সৈনিক।

তার মৃত্যুর সংবাদে নিস্তব্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের মানুষ। সে রাতেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল হয় এবং তার জানাজায় সংসদ ভবন এলাকাসহ আশপাশে দেখা যায় জনস্রোত। ওসমান হাদির হত্যার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি দেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের।

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

হাদির কণ্ঠ থেমে গেলেও, তার আদর্শে নতুন প্রজন্মের ধ্বনি

ওসমান হাদির পুরো নাম শরিফ ওসমান বিন হাদি। তার জন্ম ৩০ জুন ১৯৯৩ সালে ঝালকাঠি জ...

কুষ্টিয়া জেলা নির্বাচন অফিসে দুর্বৃত্তদের আগুন: গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে গেছে

কুষ্টিয়া জেলা নির্বাচন অফিসের স্টোর রুমে দুর্বৃত্তদের আগুনের কারণে কিছু গুরুত...

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সংসদ এলাকায় ওসমান হাদির জানাজা সম্পন্ন

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির জানাজা আজ শনিবার বেলা দুইটায় জাতী...

কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে দাফন করা হবে হাদিকে

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে দাফন করা হবে শরিফ ওসমান হাদিকে।...

হাদির কবরের পাশে কান্নায় ভেঙে পড়লেন হাসনাত আব্দুল্লাহ

শহীদ শরিফ ওসমান হাদিকে কবরে শোয়ানোর পর মাটি দিয়ে কান্না ভেঙে পড়লেন এনসিপির দক...

হাদির কণ্ঠ থেমে গেলেও, তার আদর্শে নতুন প্রজন্মের ধ্বনি

ওসমান হাদির পুরো নাম শরিফ ওসমান বিন হাদি। তার জন্ম ৩০ জুন ১৯৯৩ সালে ঝালকাঠি জ...

চাকরিয়ায় অটোরিকশা ধাক্কায় শিশু নিহত

কক্সবাজারের চকরিয়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দুর্ঘটনায় তানিয়া আকতার (১০) নামে এ...

থানা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেফতার ১

চট্টগ্রামের একটি থানা থেকে লুট হওয়া একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। লক্...

তুমি সব বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে: প্রধান উপদেষ্টা

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বীর ওসমান হাদি, তোমাকে...

হাদির কবরের পাশে কান্নায় ভেঙে পড়লেন হাসনাত আব্দুল্লাহ

শহীদ শরিফ ওসমান হাদিকে কবরে শোয়ানোর পর মাটি দিয়ে কান্না ভেঙে পড়লেন এনসিপির দক...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা