মতামত

প্রতিশ্রুতির রাজনীতি থেকে জবাবদিহির রাজনীতি

মোঃ আয়নুল ইসলামঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি প্রতিশ্রুতি। প্রতিটি নির্বাচনী ইশতেহার, প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন, এমনকি প্রতিটি সমাবেশের মঞ্চে জনগণকে আশ্বস্ত করা হয় নানা প্রতিশ্রুতিতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই প্রতিশ্রুতিগুলোর কতটুকু বাস্তবায়ন হয়?

আজকে খতিয়ে দেখবো, আমাদের রাজনীতিতে জবাবদিহির অভাব কেন, এবং আমরা কবে সেই কাঙ্ক্ষিত "জবাবদিহির রাজনীতি"-তে পৌঁছাতে পারব।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে নির্বাচন মানেই ছিল প্রতিশ্রুতির ঝুড়ি। উন্নয়ন হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, সুশাসন আসবে, দুর্নীতি কমবে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটবে—এমন সব প্রতিশ্রুতি জনগণ বারবার শুনেছে।

স্বাধীনতার পরপরই খাদ্য ঘাটতি পূরণ, শিক্ষা বিস্তার, দারিদ্র্য দূরীকরণকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে শিল্পায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রসার, নারীর ক্ষমতায়ন, এমনকি গ্রাম থেকে শহরে অবকাঠামো উন্নয়ন—সবই নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলো।

তবে বাস্তবে দেখা যায়, এসব প্রতিশ্রুতির একটি অংশ হয়তো বাস্তবায়ন হয়, কিন্তু বেশিরভাগই থেকে যায় অসম্পূর্ণ বা উপেক্ষিত। ফলাফলস্বরূপ জনগণের মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাজনীতিবিদরা জনগণের প্রতিনিধি। তাদের কাজ হলো জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া এবং প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই জবাবদিহিতা তেমনভাবে তৈরি হয়নি।

নির্বাচনের পর জনগণ প্রায় ভুলে যায়, কারা কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আবার নেতারাও সচেতনভাবে এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যান। জনগণের সামনে এসে তারা হয়তো নতুন প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু পুরোনোগুলোর বাস্তবায়নের হিসাব তেমন দেন না।

এই সংস্কৃতির ফলে রাজনীতিতে এক ধরনের "অপ্রকাশিত দায়মুক্তি" তৈরি হয়েছে। জনগণ ভোট দেয়, নেতারা প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু বাস্তবতার মেলবন্ধন খুঁজে পাওয়া যায় না।

জবাবদিহি ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন। একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ সবসময় প্রশ্ন তুলতে পারে কেন প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি? কোথায় ব্যর্থতা ছিল? আর সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া রাজনীতিবিদদের নৈতিক দায়িত্ব।

যেখানে জবাবদিহি নেই, সেখানে দুর্নীতি বেড়ে যায়, সুশাসন ভেঙে পড়ে, আর জনগণের আস্থা কমে যায়। এ কারণেই উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাজের রেকর্ড খুব স্পষ্টভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়। সেখানে প্রতিশ্রুতির সাথে সাথে অর্জন আর ব্যর্থতার সঠিক পরিসংখ্যানও দেওয়া হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক মঞ্চে প্রতিশ্রুতির রাজনীতি আবারও জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দল আবারও জনগণের সামনে নানা স্বপ্নের বয়ান হাজির করেছে।

উন্নয়ন প্রকল্পের ঘোষণা, নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি—এসব শোনার পাশাপাশি জনগণ দেখতে পাচ্ছে বাস্তবতার ফারাক। বেকারত্বের হার এখনও বেশি, স্বাস্থ্যখাত এখনও সংকটাপন্ন, শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আসেনি, আর দুর্নীতি যেন সমাজের প্রতিটি স্তরে বিস্তার লাভ করেছে।

বাংলাদেশে জবাবদিহির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এখানে উল্লেখ করা হলো:

১.ইশতেহারের অগ্রগতি প্রতিবেদন: প্রতি বছর রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিয়ে একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে।
২. গণমাধ্যমের ভূমিকা: সাংবাদিকদের উচিত প্রতিটি প্রতিশ্রুতির ফলো-আপ করা, এবং জনগণকে জানানো আসল অবস্থা কী।
৩. জনগণের সচেতনতা: ভোট দেওয়ার আগে জনগণকে প্রতিশ্রুতি শোনার পাশাপাশি অতীতের কাজের হিসাব চাইতে হবে।
৪. শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ: তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে ইতিবাচক ও জবাবদিহিমূলক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে এগিয়ে আসতে হবে।
৫. প্রযুক্তির ব্যবহার: সরকারি প্রকল্প ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির অগ্রগতি অনলাইনে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনীতি যদি শুধুই প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে জনগণের আস্থা ক্রমেই ক্ষয় হতে থাকবে। আর আস্থাহীন গণতন্ত্র কখনোই টেকসই হতে পারে না। এখন সময় এসেছে রাজনীতিকে নতুনভাবে ভাবার—যেখানে প্রতিশ্রুতি থাকবে, তবে তার সাথে থাকবে জবাবদিহির কঠোর সংস্কৃতি।

আমরা সেই দিনটিই দেখতে চাই, যেদিন রাজনীতি আর ক্ষমতার খেলা হবে না, বরং হবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সেবার হাতিয়ার। প্রতিশ্রুতির রাজনীতি থেকে বের হয়ে যখন জবাবদিহির রাজনীতিতে আমরা প্রবেশ করব, তখনই সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে উন্নয়ন ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের পথে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আমার বাঙলা/আরএ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

 পল্টনে আজ ৮ দলের যৌথ সমাবেশ

অভিন্ন পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা আট দল আজ মঙ্গলবার (১১ নভেম্ব...

ময়মনসিংহে বাসে অগ্নিসংযোগ, ঘুমন্ত চালক নিহত

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছ...

সশস্ত্র বাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা বাড়ল সাড়ে ৪ মাস

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র...

১৩ নভেম্বর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচির...

কঠোর নিরাপত্তায় ঢাকা, মোড়ে মোড়ে তল্লাশি

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্...

পে স্কেল বাস্তবায়ন নিয়ে যা বললেন অর্থ উপদেষ্টা

পে স্কেল বাস্তবায়নে আরও কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর...

আওয়ামী লীগ নেতার গ্রেফতারের প্রতিবাদে সুবর্ণচরে বিএনপির ‘বাজার লকডাউন'

নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার খাসেরহাট বাজারে আওয়ামী লীগ নেতা আনিসুল হক জাহাঙ্গী...

মির্জা ফখরুলের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলারের সাক্ষাৎ

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায়...

জামায়াতের হাতে আওয়ামী লীগের বিচার আমি চাই না: তারেক রহমান

আ. লীগের চেয়ে জামায়াত হাজার গুনে অপরাধী বলে মন্তব্য করেছেন ‘আমজনতার দল&...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা