প্রতীকী ছবি
মতামত

প্রধান অতিথি এবং দূরদর্শী বিএনপি’র গল্প

সোহেল অটল

একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৬০ বছরপূর্তী অনুষ্ঠিত হবে। পুরনো শিক্ষার্থীদের মিলন হবে। বিরাট আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।
বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী মিলে অনুষ্ঠানে হাজারখানেক মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। আড্ডা-খেলাধুলা, স্মৃতিচারণের আয়োজন করা হয়েছে।

প্রায় চারদিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানের সূচী প্রকাশের আগে সবাই ভাবলেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়টা রাঙিয়ে তুলতে গানবাজনার আয়োজন করলে মন্দ হয় না।

কিন্তু গানবাজনা তো খরচের ব্যাপার। এই বিরাট খরচ কে বহন করবে?

এ ধরণের জমায়েতে বাড়তি খরচ সামলানোর জন্য অতিথির দারস্থ হওয়া এদেশে নিয়মসিদ্ধ। সিদ্ধান্ত হলো, ৬০ বছরের পুরনো এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যানিকেতনে একজন ‘প্রধান অতিথি’কে আমন্ত্রন জানানো হবে। অতিথির জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যে আলোকিত হবেন শিক্ষার্থী, এলাকাবাসী-- সবাই।

প্রধান অতিথি পাওয়া গেল। কিন্তু গোল বাঁধল অন্য জায়গায়।

স্থানীয় বিএনপি কর্মীরা এক প্রকার হুংকার ছেড়ে বলে উঠলেন, ‘এখানে বিএনপির নেতা ছাড়া কেউ প্রধান অতিথি হতে পারবে না। বিএনপি কি মরে গেছে যে তাদের বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অতিথি করতে হবে?’

বড়ই ন্যায্য কথা! বিএনপি যে মরে যায় নাই, গত পাঁচ আগস্টের পর তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় টের পাওয়া যাচ্ছে। খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পর্দায় বিভিন্ন বিএনপি নেতার কর্মব্যস্ততা নিয়মিত দেখা যাচ্ছে। তাতে দেশবাসী ফিসফাস শুরু করেছে-- ‘তাহলে কি আগেই ভালো ছিলাম?’

তবুও সবাই নড়েচড়ে বসলেন। অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির মধ্যে এটা-ওটা কথা শুরু হলো। ‘এটাতো রাজনৈতিক কোনো সভা-সমাবেশ নয় যে রাজনৈতিক নেতাকে প্রধান অতিথি হতে হবে। বরং একজন শিক্ষাবিদ হলেই ভালো হয়।’ কেউ কেউ বললেন।

কে শোনে কার কথা। স্থানীয় বিএনপি’র মুখে এক কথা--‘আমার নেতা প্রধান অতিথি হবেন। হবেনই।’

এরপর আর কথা চলে না। কমিটির ঘাড়ে তো মাথা একটাই। প্রধান শিক্ষকেরও এক মাথা।

প্রধান অতিথি হিসেবে স্থানীয় বিএনপি’র দাবী মেনে নেওয়া হলো। তবে কমিটির কর্তারা বলে দিলেন, ‘এখানে রাজনৈতিক বক্তব্য না দিলেই ভালো হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান অতিথি যদি প্রজন্মের জন্য আলোকিত বক্তব্য রাখেন, দিকনির্দেশনা দেন, তাহলে জাতী উপকৃত হবে।’

প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হলেন জাতীয়তাবাদী যুবদল-ঢাকা মহানগর এর এক শীর্ষ নেতা। তিনি স্কুল সংশ্লিষ্ট এলাকার সন্তান।

নির্ধারিত দিনে সবাই অপেক্ষা করছে প্রধান অতিথি আগমনের। ড্রাম বাজিয়ে, স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ফুল হাতে দাঁড়িয়ে থাকলো তার পদার্পনের আশায়। একসময় প্রধান অতিথি উপস্থিত হলেন।

যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে প্রধান অতিথিকে বরণ করে নেওয়া হলো। কমিটিকে বিষ্ময় উপহার দিয়ে প্রধান অতিথি রাজনৈতিক বহর নিয়ে হাজির হলেন।

কে ছিলেন না সেই বহরে? উপজেলা বিএনপির সব নেতার উপস্থিত থাকতেই হবে। তাদের মাথায়ও একটা মাথা। কিন্তু যাদের মাথা হারানোর ভয় নেই, সাংবাদিকেরা, তারাও রাজনৈতিক বহরে যুক্ত হলেন। স্থানীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি-সেক্রেটারি, কলেজের প্রিন্সিপ্যাল- বাদ যাননি কেউই।
স্থানীয় সাংবাদিক নেতাদের এমন করে বিএনপি নেতার বহরে যুক্ত হওয়া দেখে মনে পড়ল- পাঁচ আগস্টের পর কেন এক শ্রেণির সাংবাদিক দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র ওই সব সাংবাদিক তাবত সাংবাদিক সমাজকে কলঙ্কিত করেছিলেন নিজেদের লেজুড়বৃত্তির কারণে। সে ধারা এখনো চলমান।

তবে মূল বিষ্ময় তখনো বাকি। প্রধান অতিথির সঙ্গে এসেছেন একঝাঁক উঠতি নেতা। তাদের ‘প্রিয় অভিভাবকের’ পদলেহন আওয়ামী ফ্যাসিজমকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। মুহূর্তের মধ্যে তারা মঞ্চ দখল করে নিলেন। স্কুলের অনুষ্ঠান কমিটিকে ‘সাইড’ করে দিলেন। এবার এটা ঠিকঠাক রাজনৈতিক মঞ্চ হয়ে উঠল। বহরের সঙ্গে আগত কর্মীরা নির্লজ্জ তোষামোদির সঙ্গে ঘোষণা করতে লাগলেন প্রধান অতিথিসহ স্থানীয় বিএনপি নেতাদের নাম এবং পদবী। বারবার। কণ্ঠে যথাসম্ভব তেজীভাব বজায় রাখলেন এসব ঘোষক। কারণ আগত দর্শনার্থীদের বোঝাতে হবে, ‘আমাদের গলার জোর এবং বাহুর জোর কম নয়।’

প্রধান অতিথি বেচারাকে কিছুটা অসহায় দেখা গেল। কিছুটা বিব্রতও। স্পষ্টতই তিনি এই অতি-তোষামদে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। সম্ভবত একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এতটা রাজনীতিময় হয়ে ওঠাটা তিনিও উপভোগ করছিলেন না। তবে অল্প সময়ের মধ্যে তিনিও এই অসহায়ত্ব কাটিয়ে উঠলেন। বক্তব্য দিতে উঠলেন ডায়াসে। এবং অপ্রত্যাশিতভাবে তার বক্তব্যে ‘নির্বাচনী প্রচারণা’ ছাড়া আর কোনো সারবস্তু পাওয়া গেল না। তিনি সরাসরি ধানের শীষে ভোট চাইলেন।

বিএনপি নেতাদের এই দূরদর্শীতা অবাক করার মতো। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, যেখানে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জমায়েতই বেশি, সেখানে ধানের শীষে ভোট চাওয়াটাই কি প্রধান বক্তব্য হতে পারে? এই শিক্ষার্থী, এবং এলাকার জমায়েত কিন্তু তেমনটা আশা করে নাই। তারা আলোকিত হবার কথা শুনতে চেয়েছিলেন। তারা শিক্ষা বিষয়ক কোনো বক্তব্য শুনতে চেয়েছিলেন।

রাজনৈতিক নেতা হলে যে শিক্ষা বিষয়ক বক্তব্য দেওয়া যাবে না, তা তো নয়। বরং এমন অনুষ্ঠানে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য সংশ্লিষ্ট নেতার গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়িয়ে তোলে।

অনেক সময় নেতা তার ইচ্ছেমত চলতে পারেন না। বলতেও পারেন না। কর্মীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হন। কর্মীদের তোষামোদী নেতাকে বিভ্রান্ত করে। এক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছে কি-না জানা নেই।

তবে, বিএনপি নেতাদের এই কর্মকাণ্ড যদি চলমান থাকে, তাহলে ক্ষমতা হাত থেকে ফসকে যাওয়ার চান্স আছে। বিএনপির নেতারা এখনই যেভাবে নিজেদের ক্ষমতার বলয়ে দেখছেন, এবং ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন- তাতে বিএনপির জনপ্রিয়তা যে কমছে, বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।

এবার স্কুলটির নাম বলা যাক। পলাশ বাড়ীয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়। মাগুরা জেলায় অবস্থিত। আমি এই স্কুলের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। সঙ্গত কারণে আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম।

প্রধান অতিথি’র বিদায়ের পর স্কুলমাঠে শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দারুণ কিছু শিল্পী মঞ্চ মাতিয়ে তোলেন। আগত প্রায় হাজার পাঁচেক মানুষ মেতে ওঠেন সুরের মূর্ছনায়। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ‘রাজনৈতিক শো’ ততোক্ষণে মাথা থেকে উধাও।

গভীর রাতে বাড়ি ফেরার সময় লক্ষ্য করি স্কুলের মাঠ ফাঁকা। সেই ফাঁকা মাঠে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। কৌতূহল বশত মাঠে ঢুকে দেখি স্কুলের অনুষ্ঠান আয়োজক কমিটির আহবায়ক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। চারপাশে দণ্ডায়মানেরা অনুষ্ঠানের সাউন্ড সরবারহ কোম্পানীর লোক।

জিজ্ঞেস করলাম- কী হয়েছে?

আহবায়ক মাথা থেকে হাত না সরিয়েই, প্রচণ্ড হতাশা এবং দুঃখের সঙ্গে বললেন- প্রধান অতিথি টাকা দেন নাই। এখন এসব টাকা আমি কোথায় পাবো?

--------
সোহেল অটল: সাংবাদিক এবং লেখক

[email protected]

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

‘মরব, তাও গাজা ছাড়ব না’

ফিলিস্তিনের গাজা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড...

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অনেকটা

রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বা...

সুর পাল্টালেন জেলেনস্কি, রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ

যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী ইউক্...

সুপেয় পানির কষ্ট, ৩০ ফুট গভীর থেকে সংগ্রহ

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের ঘেড়...

সংসার ভাঙছে জাস্টিন-হেইলির

আরো একবার গভীর অন্ধকারে পথে পপ তারকা জাস্টিন বিবার...

৮ স্থলবন্দর বন্ধ করতে চান নৌ উপদেষ্টা

আয় না থাকায় বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার আটটি স্থলবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বলে...

একুশে পদক পাচ্ছেন ১৪ বিশিষ্টজন ও জাতীয় নারী ফুটবল দল

ভাষা আন্দোলন, শিল্পকলা, ভাষা ও সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানে...

প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগেই ভারতীয় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত!

নিয়মিত প্রশিক্ষণের আগে ভারতের একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৬...

শেখ হাসিনাকে বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত রাখতে ভারতকে অনুরোধ বাংলাদেশের 

দিল্লিতে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সাবেক প...

শেখ হাসিনার সহিংস আচরণের প্রতিক্রিয়ায় ৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুর

ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে অ...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা