স্টার সিনেপ্লেক্সের বাইরে টিকিট কেটে দাঁড়িয়ে দুই তরুণ। উড়াল সিনেমার টিকিট কেটেছেন তাঁরা। শো শুরু হতে তখনো ২০ মিনিট। সিনেমার পোস্টারের সঙ্গে ছবি তুলে সময় কাটাচ্ছিলেন তাঁরা। একজন আরেকজনকে বললেন, ‘আয় তো দেখি সামনে কি ছবি আইতাছে।’ তাঁরা দেয়ালে ঝোলানো পোস্টারবক্সে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমার পোস্টার খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু নতুন কোনো বাংলা সিনেমার পোস্টার না দেখে একজন অন্যজনকে বললেন, ‘এখন ঈদ ছাড়া ছবি চলে না। কোনো ছবি নাই।’
ঈদুল আজহায় একসঙ্গে মুক্তি পেয়েছে ছয়টি সিনেমা। তারপর পেরিয়ে গেছে তিন মাসের বেশি সময়। এ সময় নতুন সিনেমা মুক্তি পেয়েছে মাত্র তিনটি-আলী, উড়াল ও জলরঙ। এর মধ্যে গত দুই সপ্তাহ পরপর মুক্তি পেয়েছে উড়াল ও জলরঙ। তার আগের দুই মাসে কোনো সিনেমা মুক্তি পায়নি। ঘুরেফিরে ঈদের সিনেমাগুলোই বিভিন্ন হলে চলছিল। আগামী সপ্তাহে কোন সিনেমা মুক্তি পাবে, তা-ও এখনো অজানা। যেমন হঠাৎ করেই গত বুধবারে জানা যায় সিনেমা হলে মুক্তি পাচ্ছে জলরঙ। ছবিটি আগে ওটিটিতে মুক্তি পেয়েছিল।
আগস্টের এখনো তিন শুক্রবার আছে। এই তিন শুক্রবারে কোন কোন সিনেমা মুক্তি পাবে, এখনো জানা যায়নি। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কী কী সিনেমা মুক্তি পাবে, সেগুলো নিয়েও তেমন কোনো আলোচনা, প্রচারণা বা তোড়জোড় নেই। বছরের শুরুতে কিছু সিনেমা এই সময় মুক্তির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ তালিকায় ছিল সাবা। আগস্টে মুক্তির কথা ছিল। এ ছাড়া ঈদ থেকে সরে যাওয়া পিনিক, শিরোনাম, সর্দারবাড়ির খেলা, নাদান মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিনেমাগুলো মুক্তি নিয়ে নতুন কোনো তথ্যই এখন নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সিনেমার প্রযোজক জানালেন, সিনেমাটি দুর্গাপূজায় মুক্তি দিতে চাইছেন পরিচালক, কিন্তু দেশের এ পরিস্থিতিতে তাঁরা আগামী ঈদুল ফিতরে আসতে চান।
অথচ গত তিন মাসে শাকিব খান, সিয়াম আহমেদ, শরীফুল রাজ, মোশাররফ করিম, এ বি এম সুমনদের নিয়ে ১০টির মতো সিনেমা নির্মাণের খবর শোনা গেছে। এর মধ্যে পাঁচটিই আগামী ঈদুল ফিতরে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে। তিনটি সিনেমা অনুদানের, এগুলোর মুক্তি নিয়ে এখনো কোনো পরিকল্পনা করেননি প্রযোজকেরা।
এ অবস্থায় সিনেমা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদকেন্দ্রিক সিনেমা দিয়ে কখনোই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না ঢালিউড। বরং ঢালিউডকে এটা আরও সংকটে ফেলছে। ‘এখন সিনেমা হলের সামনে গেলে মনে হবে এ দেশে কোনো সিনেমা হয় না। আগের মতো সিনেমা হলের সামনে কোনো দর্শক আনাগোনা দেখা যায় না। যা দেখা যায় সেটা শুধুই দুই ঈদকে ঘিরে। এভাবে সিনেমা বাঁচবে না।’ এমনটাই মনে করেন পরিচালক কাজী হায়াৎ।
তিনি আরও বলেন, ‘সে অর্থে কখনোই আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। কারণ, একটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য যা দরকার, সেটা আমাদের নেই। আমাদের সিনেমা আগে যা ছিল, সেটাও এখন নেই। দর্শক কোথায় সিনেমা দেখবে, কী সিনেমা দেখবে? সেই দর্শক কি আমরা তৈরি করতে পারছি। শুধু ঈদ ঘিরে সিনেমা মুক্তি দেওয়ায় ঢালিউড এখন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে। দুই-তিন মাসের ব্যবসা দিয়ে সিনেমা টিকে থাকবে না। এটা হয়ে যাবে মৌসুমি ব্যবসার মতো। কিছু মানুষ এর সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করবে।’
সিনেমা প্রদর্শক সমিতির নেতা আলাউদ্দিন মাজিদ প্রসঙ্গক্রমে এক সপ্তাহ আগে জানিয়েছিলেন, ‘ঈদের সিনেমাগুলো ঘুরেফিরে চলে দুই থেকে তিন মাস। আগে ঈদে মুক্তির পর সিনেমা মুক্তির একটা ধারাবাহিকতা ছিল। যেটা হলগুলো বাঁচিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এখন একেবারেই সিনেমা হল নেই। আগামী রোজার ঈদ পর্যন্ত ৭-৮ মাস কী সিনেমা চলবে, এদিকে কেউ নজর দিচ্ছেন না। অনেকের সঙ্গেই কথা হচ্ছে, [তাঁরা বলছেন] হল বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। যে দুই-তিন মাস ঈদের সিনেমা চলে, সেটা দিয়ে বাকি সময় পোষানো সম্ভব না।’
বাংলা সিনেমার সংকটের কারণে মাল্টিপ্লেক্সগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (বিপণন) মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কয়েক বছর ধরেই দেখছি সবাই ঈদকেন্দ্রিক সিনেমা নির্মাণ করছেন। আমরা এতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বছর ধরে সিনেমা মুক্তি পেলে দর্শকদের একটা ফ্লো থাকে। এভাবে সিনেমা দেখার অভ্যাস ধরে রাখা যায় না। এখন কনটেন্ট না থাকায় দর্শক হারিয়ে যাচ্ছে। হুট করে একটা বাংলা সিনেমা মুক্তি পেলে আগের মতো দর্শক আসে না। শুধু দুটি ঈদে পরিকল্পনা করে সিনেমা রিলিজ করলে ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াবে না। এ জন্য ঈদ ছাড়াও ধারাবাহিকভাবে পয়লা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, পূজা, ডিসেম্বরে ছুটি থাকে, সেই সময়কে টার্গেট করা যায়। দর্শক ধরে রাখা গেলে আমরা বাঁচব।’
সিনেমা ব্যবসার বর্তমান দশা দেখে নিয়মিত প্রযোজকদের অধিকাংশ সিনেমা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক প্রযোজক ও প্রদর্শক সমিতির এক নেতা বলেন, ‘শাকিব খানের বছরে শুধু দুই ঈদের সিনেমার শুটিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অর্থ ঢালিউডে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া। বড় তারকার সিনেমা যদি ঈদের বাইরে অন্য উৎসবগুলোয় মুক্তি না পায়, তাহলে অন্যরা কেন সিনেমা নিয়ে আসবে। আবার ঈদের সময়টাও শাকিবের দখলে থাকে। সিনেমা বানাতে এখানে কে আসবে। আগ্রহ নিয়ে লগ্নি করার লোক আসবে না।’
ঢালিউডে করোনার সময় থেকেই কমেছে সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা। বর্তমানে করোনার সময়ের চেয়েও সিনেমা নির্মাণ সংখ্যা কম। নিয়মিত সিনেমার শুটিং না হওয়ায় ঢালিউডে বাড়ছে বেকারত্ব। বেশির ভাগ অভিনয়শিল্পীর পাশাপাশি কলাকুশলীদের হাতে কাজ নেই। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য শিল্পী সমিতির সাবেক সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চনকে ফোন দিয়ে তাঁর নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। বর্তমান সভাপতি মিশা সওদাগর যুক্তরাষ্ট্র রয়েছেন। গত কয়েক বছরের নিজের কাজের সংখ্যার তুলনা করে এক নায়ক বললেন, ‘আগে বছরে ৮-১০টি সিনেমার প্রস্তাব পেতাম। সেখানে এবার দুটি চিত্রনাট্য পেয়েছি। সেই প্রযোজকেরা এখন সিনেমা নির্মাণ করবেন না। এ অবস্থায় টিকে আছি।’
পরিচালক সমিতির তথ্যমতে, ৯৫ শতাংশ পরিচালক বেকার। কেউ তথ্যচিত্র, নাটক বানাচ্ছেন। কিন্তু কেউই সিনেমার প্রযোজক পাচ্ছেন না। তাঁদের কেউ কেউ মন্তব্য করেন, ঈদ ছাড়া ঝুঁকি নিয়ে প্রযোজকেরা সিনেমা বানাতে চাইছেন না। বর্তমান সময়ের আলোচিত পরিচালকদের একজন রায়হান রাফী। নিয়মিত কাজ করছেন তিনি। রয়েছে আলাদা দর্শক। পরাণ, তুফান, তাণ্ডব দিয়ে আলোচনায় আসা এই পরিচালকও গত চার বছরে ঈদ ছাড়া কোনো সিনেমা মুক্তি দেননি। শোনা যাচ্ছে, নতুনযে সিনেমাটির শুটিং শুরু করতে যাচ্ছেন রায়হান রাফী, সেটিও ঈদে মুক্তি পাবে।
ঈদের বাইরে কেন সিনেমা মুক্তি দিতে চান না-এমন প্রশ্নে এই পরিচালক বলেন, ‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রি এখনো স্ট্যাবল না। ঈদে সিনেমা মুক্তি পেলে লগ্নি ফিরে পেতে সুবিধা হয় প্রযোজকের। সেখানেও কিন্তু আমাদের সিনেমা পাইরেসির কবলে পড়ছে। এই দিকটাও সবার খেয়াল রাখতে হবে। একটা সিনেমা পাইরেসি হলে তখন প্রযোজক, পরিচালক, ইন্ডাস্ট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা তাণ্ডব নিয়ে বড় ধরনে ক্ষতির মুখে পড়েছি। ইন্ডাস্ট্রির কথা ভেবে এখন থেকে বছরে দুটি সিনেমা নির্মাণ করব। এর মধ্যে একটি ঈদের বাইরে আগামী ডিসেম্বরে মুক্তি দিতে চাই। ঢালিউডে নিয়মিত কাজ হোক সেটা চাই।’
আমারবাঙলা/জিজি