দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি বাড়ছে। একইসঙ্গে চলতি বছর আগের তুলনায় বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার। এতে চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা আরো জটিল হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, দ্রুতই কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে আক্রান্তের হার অন্য বছরের তুলনায় বেশি হবে। এবার ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি পৌরসভাগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে এই বর্ষায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার শঙ্কা প্রবল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৬ জনের এবং দুই হাজার ৭৪ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়া উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, এটি ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেসব জায়গা মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল, সেগুলো দ্রুত নির্মূল করে এডিস মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
কীটতত্ত্ববিদ জিএম সাইফুর রহমান জানান, সামান্য বৃষ্টিও ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়াতে পারে। তিনি বলেন, বৃষ্টির পর প্রথম যে মশাগুলোর জন্ম হয়, সেগুলো মশার ঘনত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। এখনই যদি বিটিআই বা অন্যান্য পরিবেশবান্ধব লার্ভিসাইড ব্যবহার করা যায়, তাহলে বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ সম্ভব।
বিটিআই একটি প্রাকৃতিক মাটিজাত ব্যাকটেরিয়া, যা মশার লার্ভা ও অন্যান্য পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে জৈব কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সাইফুর জানান, গত বছর সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে সমন্বয় ছিল না। তবে এ বছর কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তিনি স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে সারাদেশে মশা নিয়ন্ত্রণ ইউনিট গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করাই সবচেয়ে জরুরি। একবার বৃষ্টি শুরু হলে সঙ্গে সঙ্গে এর প্রজননস্থল ও লার্ভা ধ্বংসে অভিযান চালাতে হবে। এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিলে বড় প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর সম্ভব হবে।
ঢাকার বেশকিছু এলাকার বাসিন্দা ইতোমধ্যে মশা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মগবাজারের বাসিন্দা তাহমিনা সালমা নগরে মশা বৃদ্ধির সিটি করপোরেশনের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, বাড়ির আশপাশ ও ড্রেনে মশার প্রজননস্থল ইতোমধ্যে সক্রিয় রয়েছে। শিগগির সেখান থেকে প্রাপ্তবয়স্ক মশা ছড়িয়ে পড়বে। ইদানিং বাসা-বাড়িতে প্রচুর মশা দেখা যাচ্ছে।
জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, জুরাইনের কিছু অংশে উঁচু রাস্তা নির্মাণের ফলে সারা বছর বাড়ি ও আঙিনায় পানি জমে থাকে, যা এডিস মশার প্রজননে আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। মিজানুর বলেন, সিটি করপোরেশন এখনই ব্যবস্থা না নিলে এ বছর যেসব এলাকা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার মধ্যে অন্যতম হবে জুরাইন।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এমদাদুল হক জানান, ডেঙ্গু মৌসুমে তাদের কাজের প্রস্তুতি চলছে। তিনি বলেন, নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণকর্মীরা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নিশাত পারভীন বলেন, আমাদের নিয়মিত ডেঙ্গু কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আপাতত আমরা আগের ওষুধ দিয়েই মশা মারব, সেটি কার্যকারিতা হারালে আমরা নতুন ওষুধের কথা চিন্তা করব।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মশার উৎপাদন আগের চেয়ে কম হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ মশা নিয়ন্ত্রণের কাজকর্ম খুবই কম। আর হাসপাতালেও ডেঙ্গু চিকিৎসার যে বিকেন্দ্রীকরণ করার সিস্টেম, সেটি এখন নেই। যে অপারেশন প্ল্যান ছিল, সেটিও এখন স্থগিত; ব্যবস্থাপনা বরং আগের চেয়ে অগোছালো। আর ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু এ বছর বাড়বে কিনা, তা নির্ভর করবে ডেঙ্গুর ভাইরাসের ধরন বা সেরোটাইপের ওপর। ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২-এ যদি এবার মানুষ আক্রান্ত হয়, তাহলে ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ খুব একটা হবে না। আর যদি সেরোটাইপ বা ধরন ডেন-৩ ও ৪ দিয়ে শুরু হয়, তাহলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং মৃত্যুও বেশি হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালে প্রথম তিন মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগী ছিল ৮৪৩ জন। ২০২৪ সালে প্রথম তিন মাসে ভর্তি হয়েছে এক হাজার ৭০৫ জন।
২০২৩ সালে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় এবং মারা যায় এক হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন। ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৫৭৫ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট ১৬ জন মারা গেছে।
বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর দেখা দেয়। দাবি করা হয়েছিল, সেই বছরে ৯৩ জন মারা যায়। এরপর তিন বছর পরে মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। তবে এটি আবার দেখা দেয় ২০১৮ সালে। সেই সময় ডেঙ্গুতে ২৬ জন মারা যায় এবং আক্রান্ত হয় ১০ হাজার ১৪৮ জন। পরে গত ২৪ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে রোগটি ভয়াবহ আকার নেয়। সে বছর তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। মারা যায় এক হাজার ৭০৫ জন।
ডেঙ্গু জ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এ কারণে প্রতিরোধই এই রোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উৎকৃষ্ট উপায়। আগে শুধু বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুর বিস্তার থাকত। ওই নির্দিষ্ট সময়টি পর্যন্ত ডেঙ্গু সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এখন যেহেতু বৃষ্টির দিনের সময় বেড়েছে, তাই সারা বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            