ঝিনাইদহে খুন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত আট মাসে জেলার ছয় উপজেলায় ৩৬ জন খুন হয়েছেন। আধিপত্য বিস্তারে রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের বিরোধেও পড়ছে লাশ।
আবার স্বজনের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে আপনজনের হাত। বন্ধুর হাতে বন্ধু ও পরকীয়া প্রেমিকের হাতেও খুনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, সেই সঙ্গে পারিবারিক কলহ-বিরোধের জেরে ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। এতে করে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। এ সময়ে জেলার বিভিন্ন থানায় ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৮টি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিচারহীনতার কারণে হত্যা ও ধর্ষণের মতো ভয়ংকর অপরাধ বেড়েছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তুচ্ছ ঘটনায় চলে যাচ্ছে মানুষের জীবন। এ জন্য সামাজিক অবক্ষয়কে দায়ী করছেন তারা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা রকম অস্থিরতার কারণে সম্প্রতি হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। তবে প্রশাসন এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ জেলা সদর হাসপাতাল চত্বরে সুজন হোসেন নামের এক বেলুন বিক্রেতাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৬ সেপ্টেম্বর হরিণাকুণ্ডুর বাকচুয়া এলাকার মিলন হোসেন নামের এক যুবককে হত্যা করে তাঁর অর্ধগলিত মরদেহ ফসলি ক্ষেতে ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা।
৩ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসায়ী তোয়াজ উদ্দিনকে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। ১৩ আগস্ট ঝিনাইদহ আদালত চত্বরে পুলিশের সামনে মঞ্জুরুল ইসলাম নামের এক যুবককে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে দুর্বৃত্তরা। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। ৭ আগস্ট সদর উপজেলার হুদাপুটিয়া গ্রামের বন্যা খাতুনকে পিটিয়ে হত্যা করে তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ২২ জুলাই সদর উপজেলার ডাকবাংলো এলাকায় একজন চাতাল শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১৬ জুন সদর উপজেলার শঙ্করপুর গ্রামে শাহাদত হোসেন নামের এক কৃষককে কুপিয়ে হত্যা করে তাঁর সন্তান ফয়সাল হোসেন।
এর আগে ১ জুন সকালে কালীগঞ্জের নাকোপাড়া এলাকায় বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ইউনুচ আলী ও মহব্বত আলী নামের আপন দুই ভাইকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ৩০ মে বিকেলে জেলা শহরের ব্যাপারীপাড়া এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার একপর্যায়ে বাগবিতণ্ডার জের ধরে জীবন হোসেন নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ১ মে সদর উপজেলার দীঘিরপাড় গ্রামে বিএনপিকর্মী মোশারফ হোসেনকে তাঁর বাড়িতে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয় নাহিদ হোসেন নামের এক যুবক। ৩ মে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই আট মাসে ঝিনাইদহে ৩৫ ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শৈলকুপা থানায় ৭ জন, সদরে ১১ জন, কালীগঞ্জে ৬ জন, হরিণাকুণ্ডুতে ৩ জন, কোটচাঁদপুরে ৩ জন ও মহেশপুরে ৬ জনকে হত্যা করা হয়েছে।
এ ছাড়া একই সময়ে জেলার ছয়টি উপজেলায় ২৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এম এ মজিদ বলেন, ‘হঠাৎ করেই ঝিনাইদহে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। ফলে তুচ্ছ ঘটনায় খুনোখুনি পর্যন্ত ঘটছে। প্রশাসন কঠোর না হলে এসব ঘটনা থামবে না। এ জন্য প্রশাসনের মেরুদণ্ড আরো শক্ত করতে হবে। নইলে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।’
অপরাধ বিশ্লেষক মো. লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘একদিকে প্রশাসনের দুর্বলতা, অন্যদিকে বিচারহীনতা। সেই সঙ্গে সামাজিক অবক্ষয় তো রয়েছেই। ফলে এসব অপরাধ বেড়েই চলেছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরো কঠোর হতে হবে।’
এ বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান জাকারিয়া বলেন, ‘সামাজিক ও পারিবারিক বিরোধের জেরে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘শুধু প্রশাসন কঠোর হলেই এসব অপরাধ দমন করা সম্ভব হবে না। এ জন্য সমাজের সবি শ্রেণিপেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।’
আমারবাঙলা/এফএইচ