শিল্প ও সাহিত্য

আড়াই কোটি প্রতিবন্ধী মানুষকে সমাজ অন্ধকারে লুকিয়ে রেখেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

ইউপিএল ও কৃষ্টি ট্রাস্টের যৌথ আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে শনিবার (৩১ মে) সাবরিনা সুলতানা রচিত শেকলবন্দি স্বাধীনতা গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।

লেখক সাবরিনা সুলতানা বলেন, ‘আমাদের চাকরি, কর্মসংস্থান, আত্মমর্যাদার জায়গায় অধিকারভিত্তিক অ্যাপ্রোচ আমাদের দেশে আসে নি। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে প্রতিবন্ধী মানুষের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।’

লেখকের সহযোদ্ধা বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্য চেঞ্জ এন্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাসের সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুবা বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আমাদের মনে আশা জাগিয়েছিল, আমরা ভেবেছিলাম কিছু পরিবর্তন আসবে। অথচ প্রতিবন্ধীদের সাথে বৈষম্য তো যায় ই নি, বরং প্রতিবন্ধী মানুষরা আন্দোলনের পর থেকে আরো বেশি হারিয়ে যাচ্ছে।’

আলোচক অধ্যাপক সামিনা লুৎফা বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের নিয়ে প্রবলভাবে একধরনের নেতিবাচক ধারণা আছে, স্টিগমা আছে, এটাও লেখক বইতে আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। এই স্টিগমার কারণে প্রতিবন্ধী মানুষেরা প্রতি মুহূর্তে মানসিক টারময়েলের মধ্য দিয়ে যান, এতে দেখা যায় সামাজিকভাবে আমরা কতখানি এমপ্যাথিহীন। আমরা তাদের কথা ভাবতে কতখানি অসুবিধা বোধ করি, সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন ও অবকাঠামোয় প্রতিবন্ধীদের কথা বিবেচনায় না নেওয়া প্রসঙ্গে নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় প্রতিবন্ধী মানুষের মঞ্চে ওঠার ব্যবস্থা না থাকাটা রাজনৈতিক, কারণ, ধরেই নেওয়া হয়, যে প্রতিবন্ধী মানুষ মঞ্চে উপবিষ্ট হবেন না।’

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সাবরিনা তার লেখায় তুলে ধরেছেন, প্রতিবন্ধীতা নিয়ে কাজের অ্যাপ্রোচটা এখনো কল্যাণমূলক। এখানে তাদের অধিকারের স্বীকৃতি নাই, কেবল সক্ষমতার কথা, উপকরণ বৃদ্ধির কথাই বলা হয়। কারো জীবনমানের উন্নতি ঘটে না। ২০১০ এ অনুমোদন হওয়ার পরেও সাড়ে চৌদ্দ বছরে ফাউন্ডেশন অধিদপ্তরে রূপান্তরিত হয়নি।’

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ভনিতা ও প্রতারণার রাজনীতি ও অর্থনীতি এখনো অব্যাহত আছে। জনগণের প্রয়োজনে কিছু চাইলেই আমরা দেখি টাকা নাই। সরকারি আমলাদের ভর্তুকি, বিদেশ সফর, ঋণ সবকিছুর জন্যই টাকা আছে, শুধু মানুষের জন্য টাকা নাই।’

প্রবল বর্ষণের মধ্যে বিদ্যুৎবিহীন এই আয়োজনটি লেখককে ধন্যবাদ জানিয়ে শুরু করেন প্রকাশক, ইউপিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহ্রুখ মহিউদ্দীন। বাংলাদেশের কোনো কাঠামো থেকে শুরু করে কোনো পরিকল্পনা বা পলিসি যে সকল মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে নির্মাণ করা হয় না, সেটি উল্লেখ করে বইটির গুরত্ব তুলে ধরেন তিনি।

লেখক সাবরিনা সুলতানা তার বক্তব্যে বইটির লেখার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন, প্রকাশককে সার্বিক সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান।

তিনি বলেন, ‘এই পৃথিবীতে সবকিছুই আমাদের চেয়ে নিতে হয়েছে। দাবি করে আদায় করতে হয়েছে। প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নতি না হওয়ার দায় আমি প্রতিবন্ধী মানুষদের দেই, প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে যারা কাজ করে তাদের দেই।
কল্যাণমুখী অ্যাপ্রোচ, মেডিকেল মডেলের আমরা তীব্র বিরোধিতা করি। আমাদের কথা কেউ শুনতে চায় না, বললে থামিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবন্ধী মানুষের যেন স্বাভাবিক জীবনের অধিকার নেই।’

আলোচক সালমা মাহবুবা তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘এত বছর পরে প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করতে গেলেও দেখা যায় প্রতিবন্ধী মানষের অবস্থা আসলে খুব বেশি পরিবর্তিত হয় নি। আগে তারা যেমন বঞ্চিত ছিল, এখনো তেমনই আছে। গৃহবন্দী প্রতিবন্ধী মানুষ ভাবে যে প্রতিবন্ধীতার সাথেই তার জীবনটা শেষ।
সিআরপি নিয়ে কথা বললেও সিআরপির বাস্তবিক চর্চা বাংলাদেশে নেই। প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়নের কোনো উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয় না। প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও ভাবে না, প্রতিবন্ধী নারী প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে আরও বেশি প্রান্তিক। নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধীতায় যারা ভোগেন তাদের পরিবার তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও বেশি উদ্বেগে থাকেন, এবং সরকারও তাদের জন্য কোনো উদ্যোগ নেয় না।’ তিনি প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন পরিবর্তনের জন্য সবাইকে আহ্বান জানান।

অধ্যাপক সামিনা লুৎফা প্রতিবন্ধীতা নিয়ে মেডিকেল মডেল ও সমাজবিজ্ঞান মডেলের দুই ধরনের অ্যাপ্রোচের প্রসঙ্গে আলোচনা করেন, তিনি বলেন, ‘মেডিকেল মডেলের দিক থেকে একধরনের ধারণা রয়েছে যে প্রতিবন্ধকতাটা ফিক্স করা যায়। এই ভাবনা সমাজের মধ্যেও আছে। সমাজবিজ্ঞানের মডেলে প্রতিবন্ধকতাকে দেখা হয় অনেক অনেক ফ্যাক্টরের জায়গা থেকে। প্রতিবন্ধকতা বিষয়টা সামাজিকভাবে নির্মিত। প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনের পথে বিভিন্ন রকমের বাধা তৈরি করে রাখার ফলে তারা একজন সাধারণ মানুষের জীবনাচারকে উপলব্ধিই করতে পারেন না অনেক সময়। যেটি তাকে সামাজিকভাবে পিছিয়ে রাখার আরও কারণ তৈরি করে। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার মানুষ যখন পরিবার থেকেও ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা পান না, তার থেকে কঠিন জীবন হতে পারে না। এমপ্যাথিসম্পন্ন হাসপাতাল সিস্টেম, কেয়ারগিভার কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না বাংলাদেশে। চিকিৎসক ও হাসপাতালের দিক থেকে যোগাযোগের ঘাটতিও একটা বড় সমস্যা।

আমি নিজে শারিরীক প্রতিবন্ধীতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় ভেবেছি পুরো অভিজ্ঞতাটা লিখে রাখা জরুরি। কিন্তু এই মানসিক, ইমোশনাল যাত্রাটাও কঠিন, এই কাজটি করার জন্য লেখককে অভিনন্দন জানাই।’

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট হওয়ার পরে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সহ বিভিন্ন ভুলভ্রান্তির সংশোধন আমি ফাইন্ড আউট করতে পেরেছি। শব্দচয়ন যে ইন্সেন্সিটিভ হতে পারে, এটাই আমাদের সমাজে এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়। আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টও শরীরের গঠন বিষয়ক যেকোনো আপত্তিকর মন্তব্যকে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বলে রায় দিয়েছেন। প্রতিবন্ধিতার শেকলের আলোচনায় ঢোকার জন্য আমাদের সমাজই আসলে প্রস্তুত নয়। আমাদের পুরো জনগোষ্ঠীর আচরণের মধ্যেই অন্তর্ভুক্তি নেই। প্রতিবন্ধীতা বিষয়ে আমি সবচেয়ে বেশি শিখেছি সাবরিনা, সালমা আপা, ইফতেখার ভাইয়ের কাছ থেকে। ৫৩ বছরে আমাদের যা কিছু অর্জন হওয়া উচিত ছিল, সেগুলির কিছুই হয়নি। আমাদের দেশে বৈষম্যবিলোপের নাম করে বছরের পর বছর ধরে টোকেনিজম চলছে।

সাবরিনাদের কথা আমাদের সবার বলতে হবে। প্রান্তিকতার মধ্যে আরও প্রান্তিক হয়ে তাকেও সবই করতে হবে এই দাবি অন্যায়। তাদের জন্য কাজ করার অঙ্গিকার আমার ছিল, আছে, থাকবে।’

নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবির বইটিকে আরো বেশি করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘আড়াই কোটি মানুষের অধিকার নিয়ে কেউ যে কোনো দায়িত্ব পালন করছেন না, সেটা নিয়ে অপরাধবোধ জাগানোর মতো একটা বই এটা। এই সমস্যাটা মূলত রাজনৈতিক।

এই অধিকারের লড়াইসহ সকল প্রান্তিক মানুষের লড়াইয়ের জন্য সাধারণ মানুষের সংবেদনশীলতে গড়ে তুলতে হবে। সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য যে সমস্ত উপকরণ দরকার সেগুলো এই বইটাতে আছে। রাষ্ট্র সমাজের মধ্যে যে বিবেকপ্রতিবন্ধিতা সেটাকে দূর করার জন্য সংঘবদ্ধতা ও লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই।’

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যে মানুষের সর্বইন্দ্রীয় এবং অঙ্গ কর্মক্ষম, তাদের জন্যও বাংলাদেশ অনেক কঠিন, সেই জায়গায় আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্মমতা অনেক বেশি। সকল প্রতিষ্ঠানে, সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, চিকিৎসা সবখানেই। যেদিন প্রতিবন্ধী মানুষ সকল প্রতিষ্ঠানে সমান সুযোগ পাবে, সেদিন বোঝা যাবে সকল প্রান্তিক মানুষের অধিকার আদায়ের পথে আমরা এগিয়েছি।

মানুষকে, প্রাণ-প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের হয় নি। মূল রাজনীতি বা সমাজ চিন্তার ধারার মধ্যে এই বিষয়টি আনতে হবে। এটা শুধু ব্যক্তির বিষয় না, জাতির বিষয়। রাষ্ট্রের একটা বড় অংশকে অবহেলা করে অপমান করে একটা জাতি কখনো বড় হতে পারে না।

শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবার, কর্মসংস্থান সকল জায়গাতেই প্রতিবন্ধী মানুষদের সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত হয়, সেজন্য আমাদের সবার কাজ করতে হবে। শেকলবন্দি স্বাধীনতা অনিবার্য নয়, এটাকে ভাঙা সম্ভব। স্বাধীনতাকে মুক্ত করা সম্ভব।’

আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন মীর মোশাররফ হোসাইন।

আমারবাঙলা/ জিজি

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

আফগানিস্তানে ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত বেড়ে ২৫০, আহত ৫০০

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে ৬ মাত্রার শক্তিশালী ও ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা...

দুপুরে সিইসির সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে ঢাকায় নিযুক্ত মা...

ডা. ফাতেমা দোজাকে বরখাস্ত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

সরকারি চাকরিতে ইস্তফা প্রদানের পর তথ্য গোপন করে পুনরায় যোগদান, যুক্তরাষ্ট্রে...

বাকৃবিতে কঠোর নিরাপত্তা, হল ছাড়ছেন শিক্ষার্থীরা

প্রশাসনের নির্দেশে হল ছাড়ছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।...

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের নেপথ্যে ছাত্রী হেনস্তা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের নেপথ্যে ছাত্রী হেনস্তাস্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ...

ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে বেলজিয়াম, ইসরায়েলকে নিষেধাজ্ঞা

ফিলিস্তিনকে চলতি মাসের শেষ দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃ...

হত্যার উদ্দেশ্যে নুরুল হককে আঘাত করা হয়েছে: মির্জা ফখরুল

হত্যার উদ্দেশ্যে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে আঘাত করা হয়েছে বলে মন্তব...

হাবিব-মনিরের নেতৃত্বে পুলিশে গড়ে ওঠে ২ গ্রুপ, জবানবন্দিতে মামুন

ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত...

বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে থাকবে : হাইকোর্ট

এখন থেকে সারা দেশের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের হা...

ঢাকায় তিন দিনের সফরে আসছেন টিআই চেয়ারম্যান

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর চেয়ারপারসন ফ্রাঁসোয়া ভ্যালেরিয়াঁ তিন...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা