বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান ও সাবেক ১৯ কর্মকর্তার তথ্য চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে রয়েছেন দুই ভারতীয় নাগরিকও। ২০১৬ সালে রিজার্ভ চুরিসহ ঋণ জালিয়াতি, অর্থপাচারসহ নানা অনিয়মে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে এই কর্মকর্তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে একটি চিঠি দিয়ে দুদক এসব কর্মকর্তার জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট নম্বর, বর্তমান পদ, আগের কর্মস্থলসহ প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েছে।
তথ্য চাওয়া দুই ভারতীয় নাগরিক হলেন—নীলা ভান্নান ও রাকেশ আস্তানা। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়ে যায়, যা দেশের ইতিহাসে অন্যতম বড় সাইবার জালিয়াতির ঘটনা।
অভিযোগ আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ভারতীয় এ দুই নাগরিক রিজার্ভ চুরির ঘটনায় জড়িত ছিলেন। নীলা ভান্নান রিজার্ভ চুরির ঠিক আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফট সিস্টেমের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে চুরির দুয়ার খুলে দেন এবং রাকেশ আস্তানা রিজার্ভ চুরির পর সব তথ্য ও ডকুমেন্ট মুছে ফেলেন। সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান তার পছন্দের লোক হিসেবে এ দুই ভারতীয় নাগরিককে নিয়োগ দিয়ে রিজার্ভ চুরির পথ সুগম করে দিয়েছিলেন। ভারতীয় এ দুই নাগরিককে যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভারে এক্সেস দেওয়া হয়েছিল, তাদের সব ধরনের তথ্য সংরক্ষণ করার কথা। তাই তাদের তথ্য তলব করা হয়েছে।
রিজার্ভ চুরির নেপথ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল দেশের অভ্যন্তরে স্থানীয়ভাবে লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত ‘আরটিজিএস’-এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ব্যবহৃত ‘সুইফট সিস্টিম’-এর সংযোগ স্থাপন। এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এর ফলে একসঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় পাঁচ হাজার কম্পিউটার এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটিএনের কয়েক হাজার কম্পিউটারের লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক। সংযোগ স্থাপনের কাজটিই করেন ভারতীয় নাগরিক নীলা ভান্নান।
গভর্নরের নির্দেশে তাকে এ কাজে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন তৎকালীন ইডি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা এবং আইটি বিভাগের তৎকালীন কর্মকর্তা ও ওই বিভাগের বর্তমান নির্বাহী পরিচালক (ইডি) দেব দুলাল রায়।
নীলা ভান্নান তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের কর্মকর্তা রিয়াজ, সালেহীন ও জোবায়ের বিন হুদার ইউজার আইডি এবং ফিঙ্গার স্ট্রোক, পাসওয়ার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অতি সন্তর্পণে জেনে নিয়ে নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। রিজার্ভ চুরির পেছনে তাই অন্যতম মাস্টারমাইন্ড হিসেবে নীলা ভান্নান অভিযুক্ত।
রিজার্ভ চুরির পর সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার থেকে এ-সংক্রান্ত সব তথ্য ও ডকুমেন্ট মুছে ফেলা হয়। দীর্ঘ দেড় মাস ধরে কাজটি করেন ড. আতিউরের নিয়োগ দেওয়া অপর ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানা। দেশের নিরাপত্তা বাহিনী, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় আইডি বিশেষজ্ঞ—কাউকে না জানিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে গভর্নর আতিউর এ কাজে নিয়োগ দেন রাকেশ আস্তানাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মেজবাউল হকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও নেপথ্যে থেকে রাকেশ আস্তানা কাজ করে যান। রাকেশকে সব ধরনের সহযোগিতা করার জন্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন তৎকলীন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) কাজী ছাইদুর রহমান। তাদের আনুকূল্যে রাকেশ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার কক্ষে ঢুকে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার থেকে রিজার্ভ চুরির সব তথ্য ও ডকুমেন্ট মুছে ফেলতে সক্ষম হন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক তদন্তেও রাকেশ আস্তানার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান কর্মকর্তাদের মধ্যে তথ্য চাওয়া হয়েছে রাজশাহী অফিসের নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক এবং আইসিটি বিভাগের দেব দুলাল রায়ের। এদের মধ্যে মেজবাউল হক গত ১৪ সেপ্টেম্বর এক মাসের নোটিস দিয়ে পদত্যাগ করেন। এ তালিকায় রয়েছেন—কমন সার্ভিস বিভাগ-২-এর পরিচালক মো. তফাজ্জল হোসেন, বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স কাউন্সিলের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ, আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মসিউজ্জামান খান ও রাহাত উদ্দিন।
চিঠিতে মসিউজ্জামান খানের নাম দুবার উল্লেখ আছে। অপর জায়গায় তার পরিচয় উল্লেখ রয়েছে উপপরিচালক হিসেবে। যদিও দুজনই একই ব্যক্তি বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে মাসুম বিল্লাহ ছাড়া অন্য সবাই রিজার্ভ রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। রিজার্ভ রক্ষণাবেক্ষণ ও ছাড়ের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের চারটি বিভাগের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিভাগগুলো হলো—ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট, আইটি, পেমেন্ট সিস্টেম এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগ।
তালিকায় আরো আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির এবং আব্দুর রউফ তালুকদার। রিজার্ভ চুরির সময় আতিউর রহমান গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন। চুরির তথ্য ফাঁসকে কেন্দ্র করে ওই বছরের ১৫ মার্চ তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এছাড়া সাবেক সাত ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী, আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, এসএম মনিরুজ্জামান, কাজী ছাইদুর রহমান, আবু ফরাহ মো. নাছের, আহমেদ জামাল এবং ডেপুটি গভর্নর পদমর্যাদার বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসের তথ্য চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সাবেক নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহাও আছেন এই তালিকায়।
রিজার্ভ চুরিতে দায়িত্বে অবহেলা, বিগত সরকারের সময় ব্যাংক খাতের বিভিন্ন নীতি শিথিলতার মাধ্যমে লুটের সুযোগ, অর্থপাচার ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ বিভিন্ন কারণে এদের নাম এসেছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, আইসিটি বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব কর্মকর্তার তথ্য চাওয়া হয়েছে, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের সময় দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করেছিলেন কি না, সেটিও জানতে চাওয়া হয়েছে। এজন্য এসব কর্মকর্তার তথ্য তলব করা হয়।
এছাড়া তৎকালীন তিন গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নররা দায়িত্ব পালনকালে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে নীতিমালা গ্রহণ করেছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখতে এ তথ্য চাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে দায়িত্বে থাকা ২৬টি ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডির বিষয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে সরকারি ছয়টি এবং বেসরকারি খাতের ১৮টি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। তদন্তের অংশ হিসেবে তাদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদের তথ্য তলব শুরু করছে দুদক। এসব ব্যাংকে বিভিন্ন সময় অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে।
একই সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের সব গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও বিএফআইইউ প্রধান তদন্তের আওতায় এসেছেন। সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে এসব কর্মকর্তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তাদের দায়িত্বের সময়কাল বিবেচনা করা হয়েছে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সাবেক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বর্তমান কিছু কর্মকর্তাকেও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য চেয়েছে দুদক।
এর আগে গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ও ছয় ডেপুটি গভর্নর ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব তলব করে বিএফআইইউ। সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে তাদের হিসাবে অর্থ লেনদেন, হিসাব খোলার ফরমসহ যাবতীয় তথ্য চাওয়া হয়। দুদকের অনুরোধেই ব্যাংকগুলোকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দিয়েছিল বিএফআইইউ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক পরিচালক বলেন, দুদকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার নাম চেয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাড়া দেয়নি।
আমারবাঙলা/এফএইচ