ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রামে দ্রুত হারে বহুতল ভবন গড়ে উঠলেও নির্মাণবিধি মানার বিষয়ে নেই তেমন কোনো তদারকি। অনুমোদিত নকশা অমান্য, পরিবেশ ছাড়পত্রের অভাব, পাহাড় ধ্বংস ও জলাশয় ভরাটের মতো অনিয়মের কারণে শহরজুড়ে অস্থিতিশীল নগরায়ন তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়বে।
৪ লাখের বেশি ভবন নিয়ম মানে কতগুলো?
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) হিসেবে নগরে ভবনের সংখ্যা এখন ৪ লাখ ১ হাজারের বেশি। এর মধ্যে—
১–৬ তলা ভবন প্রায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার,
৭–১০ তলা ভবন ১৩ হাজারেরও বেশি,
১১–১৫ তলা ভবন ৪১৫টি,
১৬–২০ তলা ভবন ৫০টি,
আর ২০ তলার বেশি ভবনের সংখ্যা ৯।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ নির্মাণ কোড অনুসরণ না করেই তৈরি হয়েছে। প্রায় সব ভবনেই অনুমোদিত নকশা থেকে বেশি ফ্লোর বা অতিরিক্ত নির্মাণের ঘটনা ধরা পড়েছে। এতে ভবনের লোড ক্যাপাসিটি সঠিকভাবে হিসেব করা হয়নি—যা যে কোনো সময় বিপদের কারণ হতে পারে।
তদারকির ঘাটতি অনুমোদনের পরই শুরু অনিয়ম
সিডিএ প্রতিবছর প্রায় আড়াই হাজার ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলেও নির্মাণ পর্যায়ে নিয়ম মানা হচ্ছে কি না—তা নজরদারি করার কার্যকর ব্যবস্থাই নেই। ফলে অনুমোদন নেওয়ার পরই অনেক ভবন মালিক ইচ্ছেমতো ফ্লোর বাড়িয়ে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
সিডিএর উপ–প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আবু ঈসা আনসারী স্বীকার করেন, ১০ তলার বেশি সব ভবনই বহুতল হিসেবে বিবেচিত হলেও অনুমোদনের সময় সিডিএ মূলত সিভিল অ্যাভিয়েশনের ছাড়পত্র যাচাই করে। পরিবেশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য ১২টি সংস্থার অনুমোদন নেওয়াটা ভবন মালিকের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়।
পরিবেশ ছাড়পত্র নেই ফায়ার সার্ভিস অনুমোদনও নয়
৫ হাজার বর্গমিটারের বেশি আয়তনের ভবনে পরিবেশ ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক হলেও চট্টগ্রামে বহু ভবনই এই প্রক্রিয়ার বাইরে। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর অভিযান চালিয়ে ছাড়পত্রবিহীন ১৪ ভবনকে মোট ৩৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্রও অনেক ভবনেই নেই।
অন্যদিকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় কেটে ও জলাশয় ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে শত শত ভবন—যা শুধু পরিবেশ নয়, ভবনগুলোকেও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি: পুরোনো কোডে নির্মিত ভবন সবচেয়ে বিপদে
চট্টগ্রাম বার্মা সাব–প্লেটের সংযোগস্থলে হওয়ায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। শহরটি বেলেমাটির ওপর দাঁড়িয়ে—যা ভূমিকম্পে দ্রুত দেবে যেতে পারে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শহরের বহু ভবন গড়ে উঠেছে পুরোনো ১৯৯৩ সালের কোড অনুসরণ করে। সেই কোড এখন কার্যত অচল। ২০২০ সালের নতুন বিল্ডিং কোডে ভূমিকম্পের লোড ফ্যাক্টর প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে—যা না মানলে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো অসম্ভব।
তার মতে, চট্টগ্রামের হাসপাতাল, বিদ্যুৎব্যবস্থা ও বন্দরকে ভূমিকম্প–সহনশীল রাখতে হলে পুরোনো ভবনগুলোর শক্তিবৃদ্ধি জরুরি। এ জন্য আলাদা মনিটরিং সেল গঠন ও সরকারি–বেসরকারি ভবনের জন্য বিশেষ সহায়তা কর্মসূচি নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ: এখনই ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ প্রয়োজন
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান মনে করেন
সকল নতুন ভবনে বিল্ডিং কোডের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা,
অনুমোদনের পর নিয়মিত মনিটরিং চালু করা,
পুরোনো ভবনের অবস্থার ঝুঁকি নিরূপণ,
এবং জরুরি ভিত্তিতে শক্তিবৃদ্ধি কার্যক্রম শুরু করা ছাড়া উপায় নেই।
চট্টগ্রামের দুর্গম ভূপ্রকৃতি, নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম এবং দ্রুত নগরায়নের চাপে পরিস্থিতি দিনে দিনে ভয়াবহ হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞদের ভাষায় “একটি ভবন কেবল ইট–বালুর গাঁথুনি নয়, মানুষের সারাজীবনের বিনিয়োগ ও স্বপ্ন। এই স্বপ্ন যেন মৃত্যুফাঁদে পরিণত না হয় এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
আমারবাঙলা/এসএ