খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষে তিনজন মারা গেছেন। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর এক মেজরসহ ১৩ সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্য এবং স্থানীয়দের অনেকে আহত হন।
স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে তিনজনের মৃত্যু খবর নিশ্চিত করা হলেও তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলায় দুষ্কৃতকারীদের হামলায় তিনজন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন।’
পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে গতকাল শনিবার ভোর ৫টা থেকে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছেন স্থানীয়রা। এই কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি-সাজেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষাভকারীরা আঞ্চলিক, স্থানীয় এমনকি পাড়া-মহল্লার রাস্তায় গাছ, কাঠ ফেলে ও টায়ারে আগুন দিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেন।
এদিন দুপুরে খাগড়াছড়ি এবং বিকেলে গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। রাত ১০টার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।
গতকাল রবিবার সকাল থেকে আবার জেলার বিভিন্ন সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুঁড়ি ফেলে বিক্ষোভ শুরু করেন অবরোধকারীরা। দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে অবরোধ সমর্থনকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় স্থানীয় রামেসু বাজার ও আশপাশের বসতবাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসে টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পাহাড়িরা দাবি করেছেন, স্থানীয় বাঙালিরা বাজারে আগুন দিয়েছেন। হামলা ও সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হন বলে স্থানীয় পক্ষগুলো দাবি করেছে।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ বলেন, তিনজনের মরদেহ খাগড়াছড়ি হাসপাতাল রয়েছে। তাদের শরীরে গুলি চিহ্ন আছে।
খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ সাবের জানান, রবিবার বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে গুইমারা থেকে তিনজনের মরদেহ এবং গুরুতর আহত চারজনকে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে পুলিশ। মরদেহ তিনটি মর্গে রাখা আছে। আজ সোমবার ময়নাতদন্ত করা হবে। এরপর বোঝা যাবে তারা কীভাবে মারা গেছেন।
খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, হতাহতের ব্যাপারে পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একসঙ্গে কাজ করছে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যাবে। তিনি বলেন, এলাকায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সবার সম্মিলিত সহযোগিতা প্রয়োজন। দুর্গাপূজা যাতে আনন্দ-উৎসবে উদযাপন করা যায় এবং সাধারণ মানুষ যাতে স্বস্তি পান, সেই পরিবেশ তৈরিতে প্রশাসনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বাত্মকভাবে কাজ করছে।
খাগড়াছড়িতে হতাহতের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিতে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শিগগির তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
খাগড়াছড়ির গত দুদিনের পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমাসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টহল দিচ্ছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল অবরোধের সমর্থনে জুম্ম ছাত্র-জনতার ব্যানারে গুইমারা খাদ্যগুদামের সামনের সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে কর্মসূচি পালন করছিল প্রতিবাদকারীরা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেখানে গেলে কর্মসূচি পালনকারীদের সঙ্গে তাদের কথাকাটাকাটি হয়। পরিস্থিতির অবনতির এক পর্যায়ে ঘটনাস্থল থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়। এরপর ২০-২৫ জন মুখোশ পরিহিত লোক এসে রামেসু বাজার ও বসতবাড়ি লুটপাট করে। তারা কয়েকটি বসতঘর, দোকান ও মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনে অন্তত ২০টি দোকান ও বসতবাড়ি পুড়ে গেছে।
কর্মসূচি নিয়ে যা বলছে ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’
গতকাল জুম্ম ছাত্র-জনতার এক ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় সড়ক অবরোধ অনির্দিষ্টকাল চলবে। এ সময় সব পর্যটন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। বিবৃতিতে হতাহতের ঘটনার নিন্দা জানানো হয়। এর আগে সকালে এক বিবৃতিতে তাদের চার দফা দাবি তুলে ধরেছিল। দাবিগুলো হচ্ছে– ধর্ষণে জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যারা পরিকল্পিতভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করা। আহত শিক্ষার্থীদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা। শনিবার মহাজনপাড়া ও খাগড়াছড়ির অন্যান্য এলাকায় যেসব স্থানে হামলা চালানো হয়েছে, সেই ঘটনার বিচার নিশ্চিত করা।
তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন দেখছেন পার্বত্য উপদেষ্টা
খাগড়াছড়িতে চলমান আন্দোলনের পেছনে একটি পক্ষের ইন্ধন থাকতে পারে বলে জানান পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। গতকাল খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, আন্দোলনের নামে সহিংসতা তৈরি করতে সেখানে একটি পক্ষ অর্থায়ন করছে। আমি নিশ্চিত, কেউ না কেউ এদের পেছনে অর্থায়ন করছে। তিনি বলেন, যারা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে তাদের বয়স অনেক কম। তাদের পক্ষে গাড়ি ভাড়া খরচ করে দীঘিনালা, পানছড়ি থেকে জেলা সদরে আসা সম্ভব নয়।
সুপ্রদীপ বলেন, জেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে। নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে পাহাড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচন দেওয়া। কেউ যদি নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছাড়া কারও হাতে অস্ত্র থাকবে না।
বিচ্ছিন্ন খাগড়াছড়ি
সারাদেশের সঙ্গে এক প্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে খাগড়াছড়ি। শনিবার সকাল থেকে অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সঙ্গে দীঘিনালা, পানছড়ি, রামগড়, মহালছড়িসহ ৯ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক রোকন চৌধুরী বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের বিভিন্ন পক্ষ-বিপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি উত্তরণের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া পরিবহন সচল করা কঠিন হবে।
দুই হাজার পর্যটক নিরাপদে ঢাকায়
অবরোধের কারণে খাগড়াছড়িতে আটকে পড়া দুই হাজারেরও বেশি পর্যটককে নিরাপদে ঢাকায় পৌঁছানো হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক রোকন চৌধুরী। তিনি বলেন, শনিবার গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের উদ্যোগে দুই হাজারের বেশি পর্যটককে খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
আমারবাঙলা/এফএইচ