দুর্বৃত্তের গুলিতে আহত জুলাই অভ্যুত্থানের মুখ হিসেবে পরিচিত শরিফ ওসমান বিন হাদি বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে মধ্যরাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে । আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নিহত ওসমান হাদি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ছিলেন এবং ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। তাঁর সমর্থকদের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। “এ ধরনের ঘটনা আন্দাজ করা সরকারের উচিত ছিল। গোয়েন্দা প্রতিবেদন থাকা দরকার ছিল এবং আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কয়েকটি টার্গেট প্লেস আগে থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছিল—এটা আমরা দেখেছি।”
নজিরবিহীন হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দৈনিক প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এই দুই সংবাদমাধ্যমের ওপর যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, গতকাল শুক্রবার সরেজমিন তার ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভবনজুড়ে। পুড়ে যাওয়া অনেক নথিপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল তখনও।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে এক দল লোক শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে এসে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয়। এর এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর তারা ডেইলি স্টার কার্যালয়ে গিয়ে হামলা চালায় ও আগুন দেয়। এই ঘটনায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার তাদের প্রকাশনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়। শুক্রবার পাঠকের কাছে পত্রিকা সরবরাহ করতে পারেনি তারা। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অনলাইন কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। পরে সংবাদমাধ্যম দুটির অনলাইন চালু হয়।
ডেইলি স্টার ৯ তলা ভবনের তিনতলা পর্যন্ত আগুনের ক্ষতচিহ্ন। সপ্তম তলা পর্যন্ত ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় জুলাইযোদ্ধাদের ছবির গ্যালারি। তৃতীয় তলায় স্টোর। চতুর্থ তলায় একাধিক সেমিনার কক্ষ ও লাইব্রেরি। পঞ্চম তলায় ক্যান্টিন, ব্যায়ামাগার, স্টুডিও। ষষ্ঠ তলায় ফটো, বিজ্ঞাপন, অ্যাকাউন্ট ও সার্কুলেশন বিভাগ। সপ্তম তলায় বার্তা বিভাগ। ভবনের বিভিন্ন তলা থেকে বৃহস্পতিবার রাতে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যামেরাসহ নানা সরঞ্জাম লুটপাট করা হয়। ক্যান্টিন থেকে খাবারসামগ্রী লুট করে হামলাকারীরা। ভবনের সামনের অংশে আগুনে বাঁকা হয়ে যাওয়া স্টিলের পাতের স্তূপ। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ভাঙা কাচ, পোড়া কাগজপত্রসহ ধ্বংসাবশেষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর এক দল লোক ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ভবনে সংবাদকর্মীরা আটকা পড়েন। তারা ফেসবুকে ভেতরের অবস্থা জানিয়ে উদ্ধারের জন্য আকুতি জানান। ভবনের ছাদে গিয়ে অবস্থান নেন অনেকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছাদে চরম অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয়ে কাটাতে হয় তাদের। ভোর ৪টার দিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস তাদের উদ্ধার করে। সহকর্মীদের উদ্ধারে গিয়ে দুর্বৃত্তের হেনস্থার শিকার হন নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবীর।
হামলার ঘটনায় প্রথম আলো তাদের অনলাইন পোর্টালে একটি বক্তব্য তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে কারওয়ান বাজারে অবস্থিত প্রথম আলোর অফিস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত আক্রমণের শিকার হয়েছে। আক্রমণকালে কর্মরত সাংবাদিকরা অনলাইন সংবাদ পোর্টাল চালানোর পাশাপাশি শুক্রবার কাগজ প্রকাশের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রথম আলোর কর্মীরা এই সন্ত্রাসী হামলার মুখে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন এবং জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যান। আক্রমণকারীরা অফিসের ভবন ব্যাপকভাবে ভাঙচুরের পর তাতে অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা অগ্নিকাণ্ডের কারণে ভবন পুড়ে যায় এবং তাতে সংরক্ষিত সম্পদ ও মূল্যবান নথিপত্র ভস্মীভূত হয়।
প্রথম আলো ঘটনা নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলে– অফিস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাওয়ায় এ ব্যাপারে নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীসহ নানা মহলের সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা পৌঁছানোর আগেই অফিস আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কর্মরত উদ্বিগ্ন সাংবাদিক ও কর্মীরা জীবন বাঁচাতে কার্যালয় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও দমকল বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
প্রথম আলো বলছে, এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারের ওপর সরাসরি আক্রমণের একটি সুস্পষ্ট নজির। তারা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানায়। পাশাপাশি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানায়। তেজগাঁও থানার ওসি ক্যশৈন্যু মারমা বলেন, হামলার ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। তবে আমরা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি। বিভিন্ন ভিডিও ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
অন্যদিকে ডেইলি স্টার বলেছে, স্বাধীন সাংবাদিকতার ইতিহাসে বাংলাদেশের জন্য এক কালো দিন ছিল বৃহস্পতিবার। এই হামলা ছিল ভয়াবহ। অনলাইনে প্রকাশিত একটি লেখায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের সহকর্মীরা যখন ছাদে আটকা পড়ে নিজেদের জীবন নিয়ে শঙ্কায়, তখন নিচে এক দল জনতা একের পর এক ফ্লোরে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধোঁয়ায় দমবন্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় কেউ হতাহত হননি এবং সবাই নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।’
আক্রান্ত হওয়ার আগে শাহবাগের ঘটনা এবং কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের অভিমুখে এক দল লোক আসার খবর পেয়ে ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে যোগাযোগ করেছিল। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তারা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন এবং ঘটনাস্থলে সহায়তা করেন। তবে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, সমন্বিত ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলে ছাদে আটকে পড়া আমাদের সহকর্মীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা চরম অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয়ে কাটাতে হতো না।
পত্রিকাটি বলেছে, একটি বিশেষ মহল বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পক্ষে থাকা দুটি পত্রিকার বিরুদ্ধে সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছে। আসন্ন নির্বাচন বানচাল করতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির আরেকটি অপচেষ্টা বলে আমরা একে মনে করছি।
পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে হামলাকারী ও তাদের ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে ডেইলি স্টার বলেছে, গণমাধ্যমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের শিথিল মনোভাব আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অতীতেও দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো বিভিন্ন মহলের হুমকির মুখে পড়েছে; কিন্তু সেসব ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হয়নি। চরম ঝুঁকির মধ্যেও যারা আমাদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন, এমনকি শারীরিক হামলার শিকার হয়েও পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রতি আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
আমার বাঙলা/আরএ