বেড়ে ওঠা ঢাকার পূর্বাচলের ইছাপুর গ্রামে। তখনকার পূর্বাচল ছিল সবুজ, খাল-বিলবেষ্টিত এক গ্রাম। হাসনাত রিপনের শৈশব কেটেছে খাল-বিলে বন্ধুদের সঙ্গে বাউন্ডুলেপনা আর গলা ছেড়ে গান গেয়ে। মাধ্যমিকে পড়ার সময় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার না পেলেও যেমন খুশি তেমন সাজো বিভাগে পুরস্কার নিশ্চিত ছিল। এখান থেকেই অভিনয়ের নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। হাসনাত রিপনের কথায়, ‘ইছাপুর স্কুল মাঠে প্রতি শীতে তখন নাটক হতো। চলত মহড়া, নির্দেশনা, নাটকগুলোতে চাচাতো ভাইদের অনেকেই অভিনয় করতেন। এর মধ্যে মাসুদ ভাই তখন তুখোড় অভিনেতা, এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল। বিষয়টি ভালো লাগত, তখন থেকেই অভিনয় করার ইচ্ছা জন্মেছে আমার মধ্যে।’
স্কুল-কলেজ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হন ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগে। অভিনয় শেখার আগ্রহে যুক্ত হন পদাতিক নাট্য সংসদে। নিয়মিত রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে গান করেন দল বেঁধে। শো করতে থাকেন শহীদ মিনার, চারুকলার বকুলতলা, রবীন্দ্র সরোবরে। সেখানে দুই বছর সময় দেওয়ার পর ভর্তি হন প্রাচ্যনাট স্কুল অব অ্যাক্টিং অ্যান্ড ডিজাইনে। ছয় মাসব্যাপী স্কুলিংয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এর পর থেকে প্রাচ্যনাটের নিয়মিত সদস্য হিসেবে অভিনয় ও নেপথ্যে কাজ করছেন তিনি। দলটির হয়ে ‘বনমানুষ’, ‘রাজা ও অন্যান্য’, ‘কিনু কাহারের থেটার’, ‘গন্ডার’, ‘কইন্যা’ নাটকে কাজ করেছেন তিনি। প্রাচ্যনাটের ‘রাজা এবং অন্যান্য’ আর ‘ট্রাজেডি পলাশবাড়ী’ নাটক নিয়ে শো করেছেন ভারতের কলকাতা, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, বহরমপুর। আরও অভিনয় করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ‘বাঁধ’, ‘বিসর্জন’ নাটকে। এর বাইরে থিয়েটারে ডিজাইন করেছেন স্কলাস্টিকা, সানবিমস, সানিডেল স্কুলের প্রোডাকশনে।
সব মাধ্যমেই সরব
২০০৭ সালে এনটিভিতে প্রচারিত ‘ইঁদুর’ নাটকের মাধ্যমে টেলিভিশনে হাসনাত রিপনের অভিনয়জীবন শুরু। তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য কাজের মধ্যে ‘ডাকাত’, ‘ইতি ফরহাদ’, ‘লেবু চায়ে আড্ডা’, ‘পুতুলের সংসার’, ‘সোনালী বিকেল’, ‘এন্ড কাউন্টার’, ‘কেস ৩০৪০’ উল্লেখযোগ্য। ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘তুমি আছ তাই’, ‘উইন্ডো’, ‘সংসার’, ‘কাচের ক্যানভাস’, ‘একদিন প্রজ্ঞার দিন’, ‘রৌদ্র ছায়ার খেলা’, ‘ফুল এইচডি’, ‘উৎসব’, ‘সাতকাহন’ এবং ‘ডেইলি ফাইট নাইট’।
ছোট পর্দার পাশাপাশি হাসনাত রিপন কাজ করছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকে বড় পর্দায়। চলতি বছর মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত ওয়েব ফিল্ম ‘আমলনামা’। তাঁর অভিনীত অন্যান্য সিরিজের মধ্যে রয়েছে ‘সাবরিনা’, ‘টেক্কা’, ‘মিশন হান্টসডাউন’ ও ‘ফ্যাঁকড়া’। কাজ করেছেন ওয়েব ফিল্ম ‘মায়া’তে।
তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘স্ফুলিঙ্গ’ সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় দর্শকের কাছে তাঁকে পরিচিত করে তোলে। গত বছর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তুফান’ সিনেমাতেও অভিনয় করেন তিনি। তাঁর অভিনীত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘বকুল ফুল’, ‘জলঘড়ি’, ‘মানুষের বাগান’, ‘পদ্মাপুরাণ’, ‘শরতের জবা’, ‘রাত জাগা ফুল’, ‘স্বপ্নজাল’ ইত্যাদি। অভিনয়ের পাশাপাশি শিল্পনির্দেশনাও দেন তিনি। রুবাইয়াত হোসেনের ‘আন্ডার কন্সট্রাকশন’ এবং তৌকীর আহমেদের ‘স্ফুলিঙ্গ’ সিনেমার শিল্পনির্দেশক তিনি।
তিন আদর্শ
অভিনয়ে ভিক্টর ব্যানার্জি, উৎপল দত্ত ও হুমায়ুন ফরীদিকে আদর্শ মানেন হাসনাত রিপন। তবে তিনি মনে করেন, আদর্শ যে কেউ হতে পারে। হাসনাত রিপনের কথায়, ‘কারও কোনো শৈল্পিক মুহূর্ত নিজের আদর্শের পথ তৈরি করতে পারে, যা আমি নানান পথ–মতের ভেতর থেকে খুঁজে ফিরি। তাই আমি আদর্শের জন্য কাউকে এককভাবে বিশেষায়িত করতে চাই না। শিল্প আসলে সত্তা যা যাপন করার বিষয়, আমি সে জীবন যাপন করতে চাই।’
গানের মানুষ
প্রাচ্যনাটের হয়ে মঞ্চে নেপথ্যে কাজ করতে গিয়ে গান করা হতো হাসনাত রিপনের। তখনই প্রাচ্যনাটের কয়েকজন বন্ধু মিলে শুরু করেন গানের দল সর্বনাম। এখন পর্যন্ত ব্যান্ডটির একটি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন, প্রস্তুতি চলছে নতুন অ্যালবামেরও। সর্বনামের পাখিরা শিরোনামের এই অ্যালবামের জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘ঝাঁপ দিয়েছি তোমার জলে’, ‘কালা মেঘ’, ‘বান্ধব’ ও ‘নামের গোসাই’। দেশের বিভিন্ন জায়গাসহ সর্বনাম গান পারফর্ম করেছে ভারতের আসাম ও আগরতলায়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে হাসনাত রিপন জানান, পরিকল্পনা করে শিল্প হয় না, বাড়তি চাপ তৈরি হয়। হাসনাত রিপন বলেন, ‘সামনের পরিকল্পনা আমার নেই। আমি আনন্দ নিয়ে কাজ করি, বর্তমান আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পে শিল্পীর কাজের আনন্দ জরুরি, আমি আনন্দেই বাঁচতে চাই। শিল্পীর কাজ আনন্দ নিয়ে কাজ করা। বলেকয়ে শিল্প হয় না। কখনো যাপনে নানান কর্মের ভেতর থেকে জাদুকরি কিছু মোমেন্ট হয়ে ওঠে, দর্শক তা দেখে বিস্মিত হয়, এটা স্বতঃস্ফূর্ত জোড়াজুড়ির বিষয় নয়।’
আমারবাঙলা/জিজি