বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় কৃষকরা কৃষি উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এই অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে দূষিত হচ্ছে পানির উৎস। দীর্ঘমেয়াদে এই রাসায়নিক মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের রোগসহ প্রজনন জটিলতা তৈরি করছে বলে কৃষি ও স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ফসলকে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে কৃষকরা মূলত এই অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে নিরাপদ খাদ্যমান বজায় রাখতে না পারার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য প্রতিযোগিতা করতে পারছে না। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলো জৈব সার ও বায়োপেস্টিসাইড ব্যবহারে জোর দিলেও বাস্তবে বড় সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে পরিবেশ ও মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। যেমন, অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহারে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপাদন হয়, যা পরিবেশের ক্ষতি করে। এছাড়া, অ্যামোনিয়া বেশি ব্যবহারের ফলে পানিতে অক্সিজেন কমে যাওয়ায় মাছের জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়ে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে সূত্রটি আরও জানায়, অতিরিক্ত কীটনাশকের কারণে মানবদেহে ক্যানসার, কিডনি বিকল এবং ফুসফুসের নানা জটিল রোগ হতে পারে। এমনকি নারীদের মধ্যে প্রজনন-সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
দেশে কীটনাশকের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে। ১৯৭২ সালে যেখানে এর ব্যবহার ছিল মাত্র ৪ হাজার টন, সেখানে ২০২৩ সালে তা প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। ধান, শাকসবজি ও ফল চাষে এটি বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে কীটনাশকের বাজার পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা এই খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার প্রমাণ।
সূত্র আরও জানায়, দেশের মোট আবাদযোগ্য জমির প্রায় ৬১ শতাংশ মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে জৈব পদার্থের বিপুল ঘাটতি তৈরি হয়েছে। অপরিকল্পিত চাষাবাদ এবং একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের কারণে জমির উর্বরতা শক্তি কমছে। একটি আদর্শ জমিতে ৩.৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা আবশ্যক হলেও দেশের বেশিরভাগ জমিতে এর পরিমাণ মাত্র ১.১৭ শতাংশ এবং কোথাও কোথাও তা ১ শতাংশের চেয়েও কম।
অপরিকল্পিত চাষাবাদ, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, বনভূমি ধ্বংস এবং অপরিকল্পিত সার ব্যবহারের কারণে মাটি উর্বরতা শক্তি হারাচ্ছে। ফলে গত এক দশকে বাংলাদেশে আবাদযোগ্য জমির মাটির উর্বরতার মাত্রা ২.৫ শতাংশ থেকে কমে ১.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
দেশে প্রায় ২৭ শতাংশ কৃষক কীটনাশকজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন। এর মধ্যে রয়েছে চোখ জ্বালা, ত্বকে ফোসকা, শ্বাসকষ্ট এবং দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার ও প্রজননজনিত সমস্যা। দেশে প্রায় ৮ হাজার বাণিজ্যিক কীটনাশক নিবন্ধিত থাকলেও অধিকাংশ কৃষক কীটনাশকের মাত্রা বা ব্যবহারবিধি মানেন না। এর ফলে খাদ্যপণ্যে বিষাক্ত অবশিষ্টাংশ থেকে যায়, যা ভোক্তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. আসাদুল্লাহ বলেন, “খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে কৃষক মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তাতে একদিকে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে খাদ্যে বিষ ঢুকছে।”
তিনি বলেন, এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারের বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে এবং কৃষকদের সময়মতো সঠিক পরামর্শ দিতে হবে। অনেক সময় কৃষকরা বিক্রেতাদের কথা মতো কীটনাশক ব্যবহার করেন, যা ক্ষতির মাত্রা বাড়ায়।
আমারবাঙলা/এফএইচ