—আপনি নাকি আবার জাতীয় দলে ফিরছেন? বিদেশের মাটিতে খেলবেন বাংলাদেশের হয়ে?
—নির্বাচকেরা কি যোগাযোগ করেছেন আপনার সঙ্গে?
—আচ্ছা, নির্বাচকেরা যদি আপনাকে দলে নেনও, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য আপনি শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটা প্রস্তুত?
তিন প্রশ্নেই নিরুত্তর সাকিব আল হাসান। এমনকি ‘নো কমেন্ট’ও নয়। মুঠোফোনের অপর প্রান্তের লম্বা ‘পজ’ পেরিয়ে যেতে হয়েছে পরের প্রশ্নে। বোঝা গেল, বিতর্কের জালে আর নিজেকে জড়াতে চান না রাজনৈতিক কারণে ‘দেশান্তরি’ সাকিব।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাঙ্গনে কয়েক দিন ধরেই আলোচনা-সাকিবকে আবার জাতীয় দলে খেলানোর উদ্যোগ নাকি নিচ্ছে বিসিবি! স্বয়ং বোর্ড সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেছেন, তিনি সাকিবের সঙ্গে কথা বলবেন। এর আগে আরেক পরিচালক ইফতেখার রহমানও একাধিকবার বলেছেন, জাতীয় দলে সাকিবের দরজা সব সময় খোলা।
সাকিবের মতো একজন যদি বাংলাদেশের ক্রিকেটে আবার ফিরে আসেন, তার চেয়ে বড় সুসংবাদ আর হতে পারে না। দেরিতে হলেও বিসিবি যদি সত্যি সত্যি সঠিক উপায়ে সেই উদ্যোগ নেয়, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
তা ছাড়া সাকিব যত দিন খেলবেন, জাতীয় দলের দরজা তাঁর জন্য বন্ধ করার নৈতিক ক্ষমতা কারও নেই। সেটা ঘোষণা দিয়ে বলারও কিছু নেই। জাতীয় দল এমন একটি জায়গা, যেখানে নিজের যোগ্যতা দিয়ে খেলতে হয়, অযোগ্যতার কারণে বাদ পড়তে হয়। এই যোগ্যতা-অযোগ্যতার পুরোটাই ওই ক্রিকেটারের ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত।
সাকিবের মতো কেউ হলে অবশ্য ‘অযোগ্যতা’র মাপকাঠি ভিন্ন কিছুও হতে পারে, যে কারণে গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে তিনি আর জাতীয় দলে নেই। গত বছরের ৫ আগস্টের পর আরও অনেকের মতো সাকিবের নামেও হত্যা মামলা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে শেয়ার কেলেঙ্কারির অভিযোগ আছে, আছে দুদকের মামলা। মোটকথা, রাষ্ট্রের চোখে সাকিব একাধিক ‘বেআইনি’ কাজ করার দায়ে একজন ‘অভিযুক্ত’।
তা এত অভিযোগের বোঝা কাঁধে নেওয়া একজন, যিনি এসব কারণেই প্রায় এক বছর হলো দেশে আসতে পারছেন না; জাতীয় দল তাঁর ‘সেবা’ দেশের বাইরেই–বা কীভাবে নেয়! রাষ্ট্রের জন্য কতটা নৈতিক হবে সেটা?
বিশেষ করে এ ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েই যখন জাতীয় দলের এক সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান এখন জেলে, আরেক সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা লোকচক্ষুর অন্তরালে। সাকিব নিজেও কি এভাবে খেলতে চাইবেন!
বিসিবির সাকিবকে দলে ফেরানোর উদ্যোগের কথা প্রকাশ্যে বলার আগে তাই কিছু প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া জরুরি ছিল। সেটা না হওয়ায় পুরো আলোচনাকেই মনে হচ্ছে দেশের ক্রিকেটামোদীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সাকিবের দেশের হয়ে আবার খেলা নিয়ে কোনো পর্যায় থেকেই তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ বা আলোচনা হয়নি। বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, তিনি সাকিবের সঙ্গে কথা বলবেন। তবে সূত্র জানিয়েছে, কিছুদিন আগে সাকিবই তাঁকে ফোন করেছিলেন, কিন্তু সাকিবের ফোন ধরতে ‘বিব্রত’ আমিনুল সেই ফোন রিসিভই করেননি।
সত্যি বলতে কি, সাকিবকে আবার জাতীয় দলে খেলানোটা বিসিবির হাতেই নেই। এ ব্যাপারে বিসিবির আগের সভাপতি ফারুক আহমেদ দায়িত্বে থাকার সময় যেটা বলেছিলেন, এখনো বাস্তবতা সেটাই আছে। বিসিবির দিক থেকে সাকিবকে দলে নিতে কোনো সমস্যা তখনো ছিল না, এখনো থাকার কথা নয়। তবে যেহেতু এখানে আইনি প্রক্রিয়ার ব্যাপার আছে, সে বিষয়টুকু সাকিবকেই আইনগতভাবে মিটিয়ে আসতে হবে।
অথবা রাষ্ট্র যদি বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁকে দায়মুক্তি দেয়, তাহলেই একমাত্র সাকিবের আবার দেশের হয়ে খেলা সম্ভব। নইলে সম্ভব হওয়া উচিতও নয়।
আইনের চোখে একজন ‘অভিযুক্ত’, যিনি দেশে এলে গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় পান, দেশের বাইরে দেশের পুলিশ নেই বলে বিসিবির তাঁর গায়ে লাল-সবুজ জার্সি পরিয়ে দেওয়াটা নৈতিকতার সঙ্গে চরম উপহাস ছাড়া আর কিছু্ই হবে না। সব অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি না পেলে সাকিব নিজেও সম্ভবত সেই উপহাসের অংশ হতে চাইবেন না।
ক্রিকেটীয় যুক্তিতেও ‘প্রবাসী’ খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ নেই সাকিবের, বিশেষ করে তিনি যখন প্রায় এক বছর দেশের ক্রিকেটের সবকিছু থেকেই সম্পর্কচ্যুত।
এ অবস্থায় সাকিবকে দলে নিতে হলে তাঁর ফিটনেস, তাঁর ফর্ম সম্পর্কে নির্বাচকদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তাঁরা কি টেলিভিশনে বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের খেলা দেখেই সাকিবকে দলে নেবেন? নিশ্চয়ই নয়।
নির্বাচক কমিটির প্রতি বোর্ডের এমন কোনো নির্দেশনাও নেই যে ‘তোমরা কিন্তু গ্লোবাল সুপার লিগে সাকিবের খেলার দিকে চোখ রেখো।’ সাকিবের অনুপস্থিতির এই সময়ে কোচও বদলেছে বাংলাদেশ দলের। দীর্ঘ বিরতির পর দলের সঙ্গে অনুশীলন না করে বিনা অভিযোজনে কীভাবে আবার ফেরেন তিনি!
তাহলে সব জেনেবুঝেও সাকিবের জাতীয় দলে ফেরা নিয়ে কেন এমন বাজার গরম করা কথাবার্তা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এর একটাই কারণ দেখেন-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাকিব–ভক্তদের ঠান্ডা রাখা এবং জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করা।
সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ দলের অধারাবাহিক পারফরম্যান্সটাকেও এখানে পুঁজি করা হচ্ছে বলে ধারণা। এই সময়ে সাকিবের মতো একজন হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালাই দরকার-পাবলিক সেন্টিমেন্টের উদরপূর্তির জন্য এর চেয়ে ভালো খাদ্য আর কী হতে পারে!
সামনে বিসিবির নির্বাচন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ঠিক পরিষ্কার নয়। এমন স্পর্শকাতর সময়ে বিসিবির স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেকে হয়তো প্রতিপক্ষের ডাগআউটে কাউকেই দেখতে চাইছেন না। তাঁরা চান, ডাগআউটের সব চেয়ার শূন্য পড়ে থাকুক। আর সে কারণেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে মুখরোচক বিষয় ‘সাকিব আল হাসান’কে সামনে নিয়ে আসা, তাঁর প্রতি কপট সহানুভূতি দেখিয়ে সাকিব অনুসারীদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টায় নামা।
বিসিবি যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত, অতীতে বহুবার তা দেখা গেছে, এখনো দেখা যাচ্ছে; সাকিবকে নিয়ে সর্বশেষ আলোচনাও সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। ফেসবুকে হিমেল হাওয়া মানে তো বাংলাদেশের ক্রিকেটেও হিমেল হাওয়া!
গ্লোবাল সুপার লিগে খেলতে সাকিব বর্তমানে আছেন গায়ানায়। সেখান থেকেই পরশু রাতে কলম্বোতে থাকা প্রথম আলোর এই প্রতিনিধিকে মুঠোফোনে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, যেটি মূলত বাংলাদেশ দলের বর্তমান অবস্থা নিয়েই।
শ্রীলঙ্কা সফরে দলের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করেছেন সাকিব। টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ব্যাটিং-উন্নতির পথরেখাও দেখিয়েছেন নিজস্ব ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ দিয়ে। যাতে পরিষ্কার-বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে সাকিবকে দূরে রাখা হলেও বাংলাদেশের ক্রিকেট তাঁর চিন্তার বড় অংশজুড়েই আছে। দলের প্রায় সব খোঁজখবরই তাঁর জানা। বর্তমান দল নিয়ে প্রবল আশাবাদী সাকিব এ–ও বলেছেন-আগামী এক বছরের মধ্যে এই দলটাই খুব ভালো দল হয়ে উঠবে।
কিন্তু নিজের ব্যাপারে কোনো কথা নয়, সাক্ষাৎকারে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন সেটাই। দেশের ক্রিকেটে তাঁকে নিয়ে চলমান মুখরোচক আলোচনা থেকে সাকিব সতর্কভাবেই দূরে সরিয়ে রাখলেন নিজেকে। কেন, তার ব্যাখ্যায় যা বলেছেন, সেটির একটাই অর্থ দাঁড়ায়-নিজেকে নতুন বিতর্কে জড়াতে চান না। যে যেভাবে পারে দেশের ক্রিকেটকে সুড়সুড়ি দিয়ে যাক, তিনি সবকিছুর নীরব দর্শক হয়েই থাকতে চান আপাতত। ভাবটা এমন-এই তো বেশ ভালো আছি!
আমারবাঙলা/জিজি