আজকালকার হিন্দি সিনেমার অনেক দর্শকের হয়তো তাঁর কথা মনে নেই। কিন্তু ১৯৩৬ থেকে ১৯৬৪; ২৮ বছরের ক্যারিয়ারে এমন অনেক কীর্তিই তিনি করেছেন যে এত দিন পরেও সুরাইয়া জামাল শেখকে নিয়ে কথা বলা যায়। আজকাল অভিনেত্রীদের পারিশ্রমিক নিয়ে অনেক কথা হয়, কিন্তু সে সময় তিনি পারিশ্রমিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন দিলীপ কুমারকেও। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাওয়া এই গায়িকা-অভিনেত্রীর মৃত্যুও নিঃসঙ্গ।
সুরাইয়ার জন্ম লাহোরে, ১৯২৯ সালে। এক বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন তখনকার বম্বেতে। ছোটবেলায় তাঁর বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন রাজ কাপুর, মদন মোহনরা। তাঁদের সঙ্গে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে শিশুদের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। ১৯৩৬ সালে ‘ম্যাডাম ফ্যাশন’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিষেক হয় সুরাইয়ার। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে সুযোগ পান আরও পরে। মাত্র ১২ বছর বয়সে সিনেমার সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তাঁর। মামার সঙ্গে নিয়মিত শুটিং স্পটে যেতেন। একদিন পরিচালক তাঁকে ‘তাজমহল’ ছবিতে ছোট মমতাজের চরিত্রে কাস্ট করেন। পরে অল ইন্ডিয়া রেডিওর শিশুদের অনুষ্ঠানে গান গাইতে গাইতেই তাঁর গায়কি মনে ধরে সংগীত পরিচালক নওশাদের। তিনিই সুইরাইয়াকে সুযোগ দেন ‘শারদা’ (১৯৪২) ছবিতে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
‘ওমর খৈয়াম’, ‘পেয়ার কি জিত’, ‘বড়ি ব্যাহেন’, ‘দিল্লাগি’র মতো সুপারহিট ছবি তাঁকে নিয়ে যায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাঁর কণ্ঠ ও রূপে মুগ্ধ ছিল গোটা ভারত। ‘ফুল’, ‘আজ কি রাত’, ‘দর্দ’, ‘নাটক’, ‘দাস্তান’, ‘চার দিন’-সবখানেই তিনি অনবদ্য। তাঁর সময়ে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া তারকা। এমনকি দিলীপ কুমারের চেয়ে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল বেশি।
গায়িকা হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিলেন
অভিনয় নয় বরং গান নিয়ে স্বপ্ন ছিল সুরাইয়ার। নওশাদের সৌজন্যে ‘শারদা’ ছবিতে গান গাওয়ার সুযোগ পাওয়ার পর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সুরাইয়াকে। তিনি ‘ফুল’, ‘সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত’, ‘আজ কি রাত’, ‘দর্দ’, ‘দিল্লাগি’, ‘নাটক’, ‘আফসার’, ‘কাজল’, ‘দাস্তান, ‘সনম’, ‘চার দিন’-এর মতো ছবিতে গান গেয়ে খুব জনপ্রিয়তা পান। তাঁকে ভারতের প্রথম গায়িকা অভিনেত্রীও বলা হয়।
দেব আনন্দের সঙ্গে প্রেম ও ভাঙন
পেশাগত সাফল্যের শিখরে থাকাকালেই সুরাইয়ার জীবনে আসেন দেব আনন্দ। একসঙ্গে সাতটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তাঁরা। দেব সুরাইয়ার এতটাই প্রেমে পড়েছিলেন যে হীরার আংটি কিনে প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
কিন্তু সুরাইয়ার দাদি এই সম্পর্কের ঘোর আপত্তি করেন। দেব ছিলেন হিন্দু, সুরাইয়া মুসলিম; এটিই ছিল প্রধান সমস্যা। আংটি ছুড়ে ফেলা হয় সমুদ্রে, পরিচালকদের বলা হয় রোমান্টিক দৃশ্য বাদ দিতে। দেব আনন্দ নাকি অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবেন সুরাইয়ার জন্য। কিন্তু সম্পর্ক টেকেনি। দেব আনন্দ পরে বিয়ে করেন অভিনেত্রী কল্পনা কার্তিককে। সুরাইয়া আর বিয়ে করেননি।
এক সাক্ষাৎকারে সুরাইয়া বলেছিলেন, ‘দেবকে বিয়ে না করায় ও আমাকে ভীতু বলেছিল। হয়তো ঠিকই বলেছিল। আমি নিজেও বুঝিনি, সাহস ছিল না। ভুল ছিল, দুর্ভাগ্য ছিল, নাকি এটাই নিয়তি?’
গ্রেগরি পেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ
হলিউড অভিনেতা গ্রেগরি পেকের প্রতি দুর্বলতা ছিল সুরাইয়ার। ১৯৫২ সালে তিনি পরিচালক ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রার মাধ্যমে তাঁর একটি অটোগ্রাফ দেওয়া ছবি পাঠান পেকের কাছে। পরে ভারতে এলে গ্রেগরি পেক সুরাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে যান। ‘আমরা ঘণ্টাখানেক গল্প করেছিলাম। সে রাতে একমুহূর্তও ঘুমাতে পারিনি,’ বলেছিলেন সুরাইয়া।
নিঃসঙ্গ মৃত্যু
দেব আনন্দের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর সুরাইয়ার অভিনয়জীবনও ঝিমিয়ে পড়ে। ১৯৫৪ সালে ‘মির্জা গালিব’ দিয়ে কিছুটা প্রত্যাবর্তন ঘটলেও, ১৯৬৪ সালের ‘রুস্তম সোহরাব’ ছিল বক্স অফিসে বড় ব্যর্থতা। তখনই সুরাইয়া সিদ্ধান্ত নেন যে স্বেচ্ছায় অবসর নেবেন। ১৯৬৩ সালেই তিনি বলিউড থেকে সরে যান। আর কখনো বড় পর্দায় বা গানে ফেরেননি। ২০০৪ সালে অসুস্থতার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়।
আমারবাঙলা/জিজি