‘মাঝের চর’-সুন্দরবনঘেঁষা বলেশ্বর নদের মধ্যবর্তী একটি চর বা দ্বীপ। পিরোজপুরের সর্বদক্ষিণে সাগর উপকূলে বৃহৎ উপজেলা মঠবাড়িয়ায় এর অবস্থান। উপজেলার বেতমোর-রাজপাড়া ইউনিয়নের ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবন সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। প্রায় ১২০০ মানুষের বাস এই চরে। দরিদ্র এই মানুষদের মূল পেশা বলেশ্বর নদে মাছ ধরা। কিন্তু নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় জীবন-জীবিকা নিয়ে তারা পড়েছেন তীব্র সংকটে।
সংসার চালানো, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ জোগানো অসম্ভব হয়েছে অনেক পরিবারের জন্য। উচ্চশিক্ষা নেই বললেই চলে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ে ছেলেরা মাছ ধরার পেশায় নিযুক্ত হয়। নেই আধুনিক চিকিৎসাসেবা। রয়েছে বিশুদ্ধ পানির অভাব। এই চরে ৩০০ ভূমিহীন পরিবারের বাস। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-প্লাবনকে সঙ্গী করে নিদারুণ কষ্টেই চলে যাচ্ছে এখানকার জেলেদের জীবন। তবে সাগর উপকূল ও সুন্দরবনঘেঁষা মাঝের চর এক আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র। প্রতিবছর শত শত পর্যটক যান নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। স্থানীয়দের দাবি-এখানে ভাসমান পর্যটনের কাঠামো গড়ে তুলতে পারলে পর্যটনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজ করে তারা তাদের জীবিকার সংস্থান করে নিতে পারবেন।
চল্লিশের দশকে জেগে ওঠা এ চরের জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৪০ একর। দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৫ কিমি. আর প্রস্থ ১ দশমিক ৪ কিমি.। পিরোজপুর, বাগেরহাট, বরগুনা, ঝালকাঠিসহ উপকূলের জেলাগুলোর ভ্রমণপিপাসুদের অতিচেনা দ্বীপ বলেশ্বর নদের মাঝের চর। যেখানে সারা বছর দেশি-বিদেশি শত শত পর্যটক ভিড় জমান। কিন্তু পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধায় নির্মিত হয়নি কোনো কাঠামো। বন্যা-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য চারদিকে নেই টেকসই বনরক্ষা বাঁধ। সরকারি ব্যবস্থাপনায় দ্বীপে বসতি শুরু হলে হাজার হাজার বৃক্ষনিধন করে ছোট ছোট কিছু রাস্তা নির্মাণ করা হয়। যেগুলো এখন ভেঙেচুরে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে।
নদীই জীবন-মরণ, জীবিকার অবলম্বন : সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, এখানকার সহজসরল মানুষগুলোর জীবন-কষ্টের অব্যক্ত কথা। প্রায় সবারই মুখ মলিন। অনেকের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। প্রায় সবার একটাই দাবি-মাঝের চরের বাসিন্দাদের বেঁচে থাকার জন্য চরের চারদিকে টেকসই বেড়িবাঁধ দরকার। ঝড়-তুফানে ভেঙে যাওয়া অসম্পূর্ণ বেড়িবাঁধ চরের মানবেতর জীবনকে আরও অসহায় করে তুলেছে। প্রতিবছর সাগর আর বলেশ্বর নদের প্রবল স্রোতে মাটির বাঁধ ভেঙে ছোট হয়ে আসছে চর। যে কারণে জমি ও বনের আয়তন হ্রাস পাচ্ছে। যারা বসতি গড়েছেন তারা সবাই পেশায় জেলে ও বর্গা চাষি। মাছ শিকারের পাশাপাশি সামান্য কৃষিকাজও করেন। জীবিকার তাগিদে নদীর জীবনকে বেছে নিয়েছেন সবাই। নদীই তাদের জীবন-মরণ আর জীবিকার একমাত্র অবলম্বন।
একটু এগিয়ে যেতেই দেখা মেলে নদীর কিনারায় ভাঙা ট্রলারের এক কোণে বসে আছেন জেলে দুলাল হাওলাদার (৪৩)। জানতে চাইলে বলেন, মন ভালো নেই। তাই বসে আছি। দুলাল আক্ষেপ করে বলেন, ‘মায়ের দোয়া’ নামের একটি বোট ছিল আমার। সর্বনাশা বন্যা তাও ভেঙেচুরে সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে। ওই বোটটিই ছিল আমার পরিবারের একমাত্র সম্বল। এখন তিনি বাকরুদ্ধ। কী করবেন, কীভাবে পরিবারের অন্ন জোগাবেন ভেবে পাচ্ছেন না। পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। সামান্য আয় দিয়ে চলত সংসার। এ থেকেই চলত ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ। এখন সবই শেষ। দুলালের ছেলে আরিফ হাওলাদার নবম শ্রেণির ছাত্র। মেয়ে লামিয়া আক্তার মঠবাড়িয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। আর ছোট মেয়ে দুলিয়া আক্তার মাঝের চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণিতে পড়ে।
দুলাল আরও জানান, এখন নিজের ট্রলার না থাকায় অন্যের ট্রলারের ইঞ্জিন নষ্ট হলে মেরামতের কাজ করেন। সামান্য কিছু টাকা আয় হয়। তা থেকেই সংসার কোনোভাবে চলে। সংসারে তার প্রতিমাসে ২০-২২ হাজার টাকা ব্যয় হয়। সেই টাকা কোথা থেকে আসবে, সারাক্ষণ এ চিন্তাই করেন তিনি।
চরের আরও এক বাসিন্দা জেলে সালাউদ্দিন হাওলাদারের (৩৫) সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমরা সাগরে যেতে পারি না। আমাদের বড় ইঞ্জিন ট্রলার নেই। তাই নদীতেই ছোট ট্রলার নিয়ে মাছ ধরি। অবসর সময়ে ছেলে-মেয়েরাও ছোট জাল দিয়ে বলেশ্বরের বুকে চিংড়ি পোনা ধরে বিক্রি করে। তার পরিবারে সদস্য সংখ্যা ৪ জন। ছেলে মহিবুল হাওলাদার (১৬) বাবার সঙ্গে নদীতে মাছ ধরে। মেয়ে নাসরিন আক্তার মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। সংসারে প্রতিমাসে তার প্রায় ২৫ হাজার টাকা ব্যয় হয় বলে জানান জেলে সালাউদ্দিন।
আরও কথা হয় চরের আরেক বাসিন্দা একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন ও জেলে সালাম জোমাদ্দার (৬০) এবং জেলে নজরুল ইসলামের (৫৫) সঙ্গে। তারা বলেন, নদীতে আগের মতো মাছ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাল ফেলে সামান্য কিছু মাছ ধরা পড়ে। এখানে কোনো বাজার নেই। চরের বাসিন্দারা সারা দিন মাছ ধরার পর যে কয়টা মাছ পায়, তা নিয়েই বিকালে রাস্তায় বসে বা নদীর কিনারায় বসে স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করেন। তবে মাছের ন্যায্য দাম আমরা পাই না। পাইকাররা বাইরে থেকে এসে চিংড়ির রেণু পোনা ক্রয় করেন। অথবা আমরা এখান থেকে মঠবাড়িয়া বাজারে নিয়ে বিক্রি করি, তাতে কিছু মাছ মারা যায়।
তিনি বলেন, মাঝের চরের বাসিন্দারা দেশের নাগরিক হয়েও পাচ্ছেন না রাষ্ট্রীয় তেমন সুযোগ-সুবিধা।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিত্যসঙ্গী : প্রাকৃতিক বিপর্যয় সিডর, আয়লা, কালবৈশাখী, ঘূর্ণিঝড়, প্লাবনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে সহায়সম্বলহীন জেলেগোষ্ঠী মানবেতর জীবনযাপন করছে মাঝের চরে। বিশুদ্ধ পানির তীব্র অভাবে সর্বদা পান করে নোনা জল। সুচিকিৎসা, শিক্ষা ও নিরাপত্তাবঞ্চিত জেলেপল্লির বাসিন্দারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এখানে নেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নেই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এ চরের সর্বোচ্চ শিক্ষালয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা প্লাবনে নিরাপত্তার ঠাঁই ছোট দুটি পুরোনো সাইক্লোন শেল্টার। আধুনিক সভ্যতার এই যুগে এ যেন এক আদিম যুগের চিত্র। জেলেপল্লির কদাচিৎ ২-১ জনের স্বাক্ষরজ্ঞান থাকলেও অধিকাংশ মানুষই এখানে স্বাক্ষরজ্ঞানহীন। জেলেদের সন্তান ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কোনোভাবে দুবেলা-দুমুঠো খেয়ে লেখাপড়া করার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা কলেজে পড়ালেখা আর সম্ভব হয় না। ঋণের ভারে জর্জরিত জেলের ছেলে জেলেই থেকে যাচ্ছে বংশপরম্পরায়। নিজ দেশে নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত চরের এই জেলেগোষ্ঠী।
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বেতমোরের সাংরাইল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার বলেশ্বর নদী নৌকা বা ট্রলারে পারাপার হয়ে মাঝেরচর আসতে হয়। চরের বাসিন্দা শুলতান চৌকিদার (৮০) জানান, সরকার ১৯৬৬-১৯৯০ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে দেড় থেকে তিন একর জমি ভূমিহীন জেলেদের মধ্যে ৯৯ বছরের জন্য ২৮৮ একর জমি বন্দোবস্ত দেয়। ১৯৭৬ সালে ৫৪৩ একর জমি বন বিভাগকে হস্তান্তর করে। মাঝেরচর জেলেপল্লির বাসিন্দা মো. হাসান (৩০) বলেন, দুঃখ-কষ্টে দিন যাচ্ছে, নদীতে মাছ ধরে সংসার আর চলে না। এই চরে অন্তত এক হাজার লোক নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। দুঃখ-কষ্ট দেখার কেউ নেই।
চরের বাসিন্দা জেলে মো. হানিফ ফকির (৬২) আক্ষেপ করে জানান, তার স্ত্রী হাসিনা বেগম (৫৬) গভীর রাতে ব্রেইন স্ট্রোক করলে তাৎক্ষণিক কোনো চিকিৎসা দিতে পারেননি। চরের জেলেগোষ্ঠীকে বাঁচাতে তিনি বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবী করেন। মসজিদের ইমাম মো. আজাদুল ইসলাম (৩০) বলেন, চরের অধিকাংশ মানুষ জেলে। এখানে নেই দ্রুত যাতায়াতের ব্যবস্থা। প্লাবন দেখা দিলে মসজিদ তলিয়ে যায়। নামাজ আদায় করা সম্ভব হয় না। মাঝেরচর ভ্রমণে আসা পশুরিয়ার কামরুল ইসলাম বলেন, মাঝের চর পরিচিত জায়গা, শিশুদের নিয়ে ঘুরতে এসেছি। তিনি এখানে একটি পর্যটনকেন্দ্র তৈরির জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
বেতমোর রাজপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যন মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, মাঝের চরের সবাই জেলে। ৩শ পরিবারের মধ্যে ৪৫০ জন ভোটার, ১৩০ জন জেলে কার্ড সুবিধা পেয়েছে এ পর্যন্ত। এখানের ভূমিহীনদের দাবি উঠেছে, মাঝের চরকে পরিবশবান্ধব ও পর্যটনশিল্পে পরিণত করা গেলে চরের সবাই কোনো না কোনো কাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে টিকে থাকতে পারবে। ফলে তাদের আর জেলে বা বেকার বসে থাকতে হবে না। এই চরের বড় অঙ্কের জমি প্রভাবশালীরা প্রশাসনের সহায়তায় বাগিয়ে নিয়েছে-এমন অভিযোগও করছেন তারা। এ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাইসুল ইসলাম বলেন, চরের বাঁধ কিছু কিছু জায়গায় সংস্কার করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে বাকি বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এখানে ভাসমান পর্যটনকেন্দ্র্র গড়ে তোলা সম্ভব।
আমার বাঙলা/জিজি