নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোওে আশানুরূপভাবে বাড়ানো যাচ্ছে না চালের উৎপাদন। বরং দেশে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার এখন বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের নিচে নেমে এসেছে। যদিও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারের দেশে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণে (২০১৫ সালের তুলনায়) নেয়ার লক্ষ্য রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার (আরএনআই) ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ছাড়া আন্তঃশুমারি গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, গত তিন অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি মাত্রায় শ্লথ হয়ে আসার পেছনে আবাদি জমি হ্রাস ও কৃষিতে নতুন জনশক্তি যুক্ত না হওয়াকে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন। কৃষি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের কৃষি খাতে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে। আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও ধানের কাক্সিক্ষত মূল্য না পাওয়ায় কৃষক অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। আবার ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতা কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের গতিকে ধীর করে তুলছে। এ কারণে যান্ত্রিকীকরণে উৎপাদন ব্যয় কমার কথা থাকলেও সে সুযোগ নিতে পারছেন না কৃষক। এ অবস্থায় কৃষি ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকেই। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয়েছিল ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। আগের অর্থবছরেও দেশে একই পরিমাণ চাল উৎপাদন হয়েছিল। সে অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে খাদ্যশস্যটির মোট উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৮৯ লাখ টনে। প্রবৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র দশমিক ২৬ শতাংশ বেড়ে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় ৩ কোটি ৯০ লাখ টনে। প্রতিবারই দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম।
কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি ভর্তুকি ও প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়া চালের উৎপাদন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব হবে না।আবার ধান উৎপাদনের ব্যয়ও বেড়েছে। সেচ ব্যয় বেড়েছে। ৬৫ শতাংশ কৃষক এখনো সেচের জন্য পেট্রলের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া কৃষিজমি হ্রাস ও তরুণদের কৃষিতে অনাগ্রহের কারণেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চালের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে চালের উৎপাদন দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় রয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশে প্রতি বছর দশমিক ৫ শতাংশ হারে কৃষিজমি কমছে। আবার কৃষিতে তররুণদের আগ্রহ না থাকায় কৃষকের সংখ্যাও কমছে। এতে চালের উৎপাদন দ্বিগুণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। যদিও কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি এসেছে। নতুন নতুন জাতও আসছে। আর তরুণ উদ্যোক্তারাও মাছ বা অন্য ফসলের চাষ করছে। তারা রপ্তানির কথা মাথায় রেখে আলু, ভুট্টা, গম ও টমেটো বা অন্য ফলন চাষ করছে। রবিশস্যের জমিতে তিল বা সরিষা চাষ হচ্ছে। তবে তারা ধান চাষে যাচ্ছে না। আর প্রান্তিক কৃষক হয়তো খোরপোশ বজায় রাখার জন্য কোনোমতে টিকে থাকবে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধানের উৎপাদন বাড়বে না।
তাছাড়া কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে আরো ব্যয়বহুল করে তুলছে ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি। যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় অনেকখানিই কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে ব্যয় বাড়ায় কৃষি যন্ত্রপাতির দামও বেড়েছে। ফলে চাইলেও কৃষকের পক্ষে এসব যন্ত্র কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে কৃষি যন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধি কৃষককে যান্ত্রিকীকরণে অনাগ্রহী করে তুলছে।
সূত্র আরো জানায়, ডলারের বিনিময় হার বাড়ায় ধান কাটার একটি হারভেস্টার মেশিনের দাম দাঁড়িয়েছে ৪২ লাখ টাকায়। ভর্তুকি পেলেও একজন কৃষকের পক্ষে ২০ লাখ টাকা জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়ছে। অথচ যন্ত্রের মাধ্যমে এক কেজি ধান উৎপাদনে ব্যয় হয় ১৮-২০ টাকা। কিন্তু প্রথাগত পদ্ধতিতে প্রতি কেজি ধানে ব্যয় হয় ৩০ টাকা। এক হেক্টর জমিতে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটালে ব্যয় পড়ে ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু ভাড়া করে যন্ত্র ব্যবহার করলে ব্যয় অর্ধেক কমে ১৪ হাজার টাকায় নেমে আসে। আর নিজের মেশিন থাকলে এটা আরো কমে ৬-৭ হাজার টাকায় এসে পড়ে। কিন্তু ধান কাটায় আমরা মাত্র ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। ধান লাগানোর ক্ষেত্রে যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। তাই যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ধানের উৎপাদন ব্যয় কমাতে হলে সারা দেশে কৃষকদের ৮০ শতাংশ হারে ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন। এতে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত বাড়বে, কমবে উৎপাদন ব্যয়ও।
আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)। ২০২১ সালে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ‘ডাবলিং রাইস প্রডাক্টিভিটি’ (ডিআরপি) শীর্ষক একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার মাধ্যমে উৎপাদন ৪ কোটি ৬৯ লাখ টনে নেয়া সম্ভব বলে জানানো হয়।
এদিকে ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর জানান, দেশে একমাত্র চালের উৎপাদনই স্বস্তির অবস্থানে রয়েছে। আলুসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন কমেছে। তবে আমরা আমরা লক্ষ্যের দিকেই যাচ্ছি। আশা করছি ২০৩০ সালের আগেই চালের উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
অন্যদিকে সার্বিক বিষয়ে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম জানান, কৃষিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আসছে। ধানের সঠিক দাম না পেয়ে কৃষক এখন ফলের চাষ করছে। উত্তরবঙ্গে আমের বাগান বাড়ছে। কোথাও মাল্টার চাষ হচ্ছে। জমিতে পুকুর হচ্ছে। কেউ পোলট্রি ফার্ম করছে। রাস্তার পাশে কৃষি জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। ফলে জমিও কমছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সেচ ও সারের মতো কৃষি উপকরণগুলোর ব্যয় বেড়েছে। তাই ধানের চাষাবাদ লাভজনক করা না গেলে বর্তমান উৎপাদনশীলতা ধরে রাখাও কঠিন হবে। এজন্য উপকরণের দাম কমাতে হবে। যান্ত্রিকীকরণ বাড়াতে হবে। উন্নত উৎপাদনশীল বীজ উদ্ভাবন করতে হবে।
এবি/এইচএন
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            