জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জুলাই জাতীয় সনদ ও সংশ্লিষ্ট সংস্কার প্রস্তাবগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। দলটি গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে জুলাই সনদের সব প্রস্তাব ও বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।
শুক্রবার (২২ আগস্ট) এনসিপি তাদের এই অবস্থান জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দেয়, যেখানে তারা জুলাই সনদের সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়ার ভিত্তিতে নিজেদের মতামত উপস্থাপন করে। একইসঙ্গে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে প্রায় একই ধরনের অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে।
এই ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান হলো, কিছু আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এগুলো অন্তর্বর্তী সরকার আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই করতে পারে। আর সংবিধানসংক্রান্ত সংস্কারগুলো আগামী জাতীয় সংসদের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
এই ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপিও। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে সনদের সমন্বিত খসড়া নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হলে খারাপ নজির তৈরি হবে।
সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘আমরা এই মর্মে একমত যে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর যে সকল প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।’
এই প্রসঙ্গে এনসিপির দেওয়া মতামতে বলা হয়, ‘কোন কোন প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, সেটা সুস্পষ্ট নয়। আমরা এর বিরোধিতা করছি।’ এনসিপি কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই জুলাই সনদ ২০২৫-এর সম্পূর্ণটাই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে।
সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়, রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এ সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এনসিপি কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই জুলাই সনদ ২০২৫-এর সম্পূর্ণটাই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে।
এনসিপির মতামতে বলা হয়েছে, কোন পদ্ধতিতে এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি বিধায় এই ধারার সঙ্গে তারা একমত নয়। এনসিপি বলছে, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এই ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপিও। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে সনদের সমন্বিত খসড়া নিয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হলে খারাপ নজির তৈরি হবে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামার বিষয়েও এনসিপি ভিন্নমত দিয়েছে। এনসিপি বলেছে, ‘এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও তার কার্যক্রম তথা বৈধতার ভার পরের সংসদের কাছে ন্যস্ত করার বিবৃতি আমরা প্রত্যাখ্যান করি। আমরা মনে করি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও তার কার্যক্রম তথা জুলাই সনদের বৈধতা গণ-অভ্যুত্থান ও অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণাপত্র।’
এনসিপি মনে করে, সাংবিধানিক কনভেনশনের নামে পরবর্তী সংসদের কাছে জুলাই সনদ ২০২৫-এর বাস্তবায়নকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। জুলাই সনদ নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করা ও এর আইনি ভিত্তি প্রদান করার কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেখা যাচ্ছে না।
ঐকমত্য কমিশনের বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনের আগেই মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত হতে হবে। তা না হলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব না। যদি গণপরিষদ নির্বাচন ছাড়াই মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার আমাদের আশ্বস্ত করতে পারে, তাহলে আমরা ইতিবাচকভাবে চিন্তা করে সে ব্যাপারে দলীয় ফোরামে সিদ্ধান্ত নেব।’
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিএনপিসহ মোট ২৩টি দল সমন্বিত খসড়া নিয়ে মতামত জমা দিয়েছে। এই তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর নামও রয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার শুক্রবার (২২ আগস্ট) সন্ধ্যায় বলেন, জামায়াত আজ শনিবার তাদের মতামত কমিশনকে দেবে।
বিশেষজ্ঞ মতও নেওয়া হচ্ছে
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এসব কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। গত ২৯ জুলাই দলগুলোকে জুলাই সনদের একটি খসড়া দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেটার ওপর দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় ‘সমন্বিত খসড়া’, যা গত ১৬ আগস্ট দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়।
প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করবে দলগুলো। এ বিষয়ে বিএনপি একমত হলেও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ আরও কিছু দলের আপত্তি ছিল। তারা সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণের দাবি জানায়।
দলগুলোর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধিত সমন্বিত খসড়ায় অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়। এই অঙ্গীকার অংশের মোটাদাগে তিনটি দফা ও ভূমিকা নিয়ে আপত্তি আছে বিএনপির। দলটি গত বুধবার ঐকমত্য কমিশনে মতামত জমা দেয়।
এদিকে সনদ বা সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
মতামত দিয়েছে ২৩ দল
সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে মতামত দেওয়ার শেষ দিন ছিল শুক্রবার (২২ আগস্ট)। ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিএনপিসহ মোট ২৩টি দল সমন্বিত খসড়া নিয়ে মতামত জমা দিয়েছে। এই তালিকায় জামায়াতে ইসলামীর নামও রয়েছে। তবে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার শুক্রবার (২২ আগস্ট) সন্ধ্যায় বলেন, জামায়াত আজ শনিবার তাদের মতামত কমিশনকে দেবে। তার আগে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না তিনি।
দলটি ভোটের আগে সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন ও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়েও সোচ্চার। গত রোববার ‘জুলাই ঘোষণা এবং জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক জামায়াত আয়োজিত এক সেমিনারে দলের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, সেগুলো অবশ্যই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করতে হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের ব্যাপারেও জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে।
ভোটের আগে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনও বেশ সোচ্চার। দলের আমির সৈয়দ রেজাউল করীম শুক্রবার (২২ আগস্ট) ঢাকার শাহবাগের ইসলামী ছাত্র আন্দোলন আয়োজিত ছাত্রসমাবেশে বলেছেন, পিআর পদ্ধতি ছাড়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আজ শনিবার ঐকমত্য কমিশনের সভা আছে। কোনো সংযোজন বা বিয়োজন থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। পরে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হতে পারে।
ইসলামী আন্দোলন শুক্রবার (২২ আগস্ট) পর্যন্ত তাদের মতামত জমা দেয়নি। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্য, গণ অধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, সিপিবি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোট মতামত দেয়নি বলে শুক্রবার (২২ আগস্ট) ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার শুক্রবার (২২ আগস্ট) সন্ধ্যায় বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে; যাতে শব্দগত, ভাষাগত বা বাক্য গঠনে কোনো ত্রুটি বা অসংগতি থাকলে সেটা প্রয়োজন অনুযায়ী সংযোজন-বিয়োজন করা যায়। এটা নতুন করে মতামত নেওয়ার বিষয় ছিল না। তিনি বলেন, সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়ার বিষয়ে ২০ আগস্টের মধ্যে মতামত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। পরে কোনো কোনো দল সময় বাড়ানোর অনুরোধ করলে ২২ আগস্ট শেষ তারিখ নির্ধারণ করা হয়। যেসব দল মতামত দেয়নি, ধরে নেওয়া হবে তাদের মতামত নেই।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আজ শনিবার ঐকমত্য কমিশনের সভা আছে। কোনো সংযোজন বা বিয়োজন থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। পরে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হতে পারে।
আমারবাঙলা/এফএইচ