১৩ বছর আগে মুক্তি পাওয়া ‘হেমলোক সোসাইটি’ ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা সিনেমা। গল্প, অভিনয়, গান আর নির্মাণ মিলিয়ে এখনো সিনেমাটিকে মনে রেখেছেন ভক্তরা। এক যুগেরও বেশি সময় পর ১১ এপ্রিল প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ‘হেমলক সোসাইটি’র সিকুয়েল ‘কিলবিল সোসাইটি’। ছবির যে বার্তা, তা এ যুগের সঙ্গে বেশ মানানসই। তাই ছবিটিও হিট হতে সময় লাগেনি। ১৩ জুন সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচইয়ে। কিন্তু প্রথম কিস্তির মতো সিকুয়েল কি পারল সেই পুরোনো ভালো লাগার বেশ ফিরিয়ে আনতে?
‘কিলবিল সোসাইটি’ দেখতে বসলে ‘হেমলক সোসাইটি’র কথা বের করতে পারবেন না মাথা থেকে। শুরুর দিকে পরমব্রত ছাড়া তেমন কোনো পরিচিত মুখ নেই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরমব্রত আর কৌশানির সংলাপ পুরোটাই জুড়ে থাকে টুকরা টুকরা ‘হেমলক সোসাইটি’। তাই যাঁরা প্রথম সিনেমাটি না দেখে ‘কিলবিল সোসাইটি’ দেখার কথা ভাবছেন, তাঁরা একবার দেখে নিতে পারেন প্রথম কিস্তি। তবে সিনেমাটি দেখার পর ‘কিলবিল সোসাইটি’ কতটা উপভোগ্য হবে, প্রশ্নটা এ জায়গাতেই। সিনেমা দেখার সময় আপনার মনে হতেই পারে, খুব কি দরকার ছিল এ সিকুয়েলের? কিংবা তরুণদের মন জয় করে নেওয়া সেই ‘আনন্দ কর’কে এভাবে ফিরিয়ে আনার?
অ্যাঞ্জেলিনা জোলির জীবনের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সৃজিত মুখার্জি লেখেন ‘কিলবিল সোসাইটি’র গল্প। জোলি ১৯ বছর বয়সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি আর বেঁচে থাকতে চান না। সে জন্য তিনি নিজেই নিজের খুনিকে ভাড়া করেছিলেন। সিনেমা মুক্তির আগে সৃজিত নিজেই সিনেমার এ কথা জানান। সিনেমার শুরুতেও বলা হয় তা। গল্পের প্লট যখন সবার জানা তখন গল্পটা সবার সামনে উপস্থাপন করা বেশ চ্যালেঞ্জের। সৃজিত কতটা মান রাখতে পারলেন, সেটাই দেখা যাক।
পূর্ণা আইচ একজন জনপ্রিয় ইনস্টাগ্রাম ইনফ্লুয়েন্সার। বেশ বড় সংখ্যার ফলোয়ার থাকায় সিনেমায় ডাক পায় সে। আর নিজের প্রথম সিনেমাতেই জিতে নেয় সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। কিন্তু প্রেমিকের সঙ্গে সে আনন্দ ভাগ করতে গিয়ে পূর্ণা দেখে, তার এ জনপ্রিয়তা মেনে নিতে পারছে না তার প্রেমিক। সন্দেহ থেকে কথা–কাটাকাটি গিয়ে গড়ায় ভাঙনে। তবে প্রেমিক এত সহজে ছেড়ে দেয় না পূর্ণাকে। নিজেদের একান্ত মুহূর্তের ভিডিও ছেড়ে দেয় ইন্টারনেটে। এ ঘটনায় দিশাহারা হয়ে যায় পূর্ণা।
একের পর এক কাজের চুক্তি বাতিল হতে থাকে, নিজের পরিবারও ভুল বোঝে তাকে। শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। সে জন্য নিজের খুনিকে নিজেই ভাড়া করে। তখন হাজির হয় ‘হেমলক সোসাইটি’র সেই আনন্দ কর। তবে এবার তার পরিচয় ভিন্ন। নিজের নাম বদলে রেখেছে মৃত্যুঞ্জয় কর। এখন সে আর মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায় না কাউকে, বরং সেই মানুষ মারে। ‘মৃত্যুকে এনজয় করো’-এটিই তার লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত পূর্ণাকে কি মারতে পারে মৃত্যুঞ্জয়? নাকি ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে?
‘কিলবিল সোসাইটি’র গল্পের বিষয় এ সময়ের সঙ্গে খুব প্রাসঙ্গিক। সিনেমা তাই শুরু থেকেই মনোযোগ ধরে রাখে। খুব বেশি সময় লাগে না গল্পের ভেতরে ঢুকতে, পরপর এগিয়ে চলে ঘটনাগুলো। সংলাপগুলো শুনতেও ভালো লাগে। কিন্তু সিনেমা দ্বিতীয় ভাগে এসেই গতি হারাতে শুরু করে। দর্শক যদিও ধারণা করতে পারেন কী হতে যাচ্ছে সামনে। টুইস্টগুলো যেন খুব সাদামাটা। আলাদাভাবে কোনো নজরই দেওয়া হয়নি। সিনেমায় কৌশানি ভালো অভিনয় করেছেন।
পরমব্রত যেন ‘হেমলক সোসাইটি’ থেকেই উঠে আসা চরিত্র! তাই তাঁর অভিনয়ও সে রকমই ছিল। তবে আলাদাভাবে বলতে হয় ‘পেট কাটা ষ’ চরিত্রের কথা। এমন দুর্ধর্ষ চরিত্রে শান্তভাব বিশ্বনাথ বসু যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা অসাধারণ। সিকুয়েল ছবিতে সাধারণত নতুন চরিত্ররা সেভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। তবে বিশ্বনাথ বসু সেটা যেন করে দেখালেন।
ছোট চরিত্র হলেও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপ্তা সেন ভালো অভিনয় করেছেন।
এ সিনেমায় সমসাময়িক বিভিন্ন সিনেমা, সেসব সিনেমার পরিচালকের কথা সংলাপের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন সৃজিত। এমনকি নিজেকে নিয়েও মজা করতে ছাড়েননি৷ কলকাতায় এক দশক ধরে থ্রিলার সিনেমার রমরমা। পারিবারিক গল্পগুলো যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। খল চরিত্র দিয়ে খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সেটা সিনেমায় নিয়ে এসেছেন সৃজিত।
সিনেমায় বেশ কিছু গান ছিল। তবে তা মোটেও হার মানাতে পারেনি ‘হেমলক সোসাইটি’র গানগুলোকে। হেমলকের গানগুলো এখনো অজান্তে গুনগুন করে যাঁরা গেয়ে ওঠেন তাঁরা এ সিনেমা শেষ করে একটা গানও মনে রাখতে পারবেন না।
এ সিনেমার সবচেয়ে দুর্বল দিক পূর্ণার অনুভূতির সঙ্গে দর্শকের একাত্মবোধ করতে না পারাটা। পূর্ণা যখন একের পর এক রহস্য সমাধান করে যায়, ধরতে পারে মৃত্যুঞ্জয়ের চাল, তখন দর্শক হিসেবে খটকা লাগে, সে কীভাবে নিজের জীবন নিতে চায়?
শেষদিকে হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রেমটাকে বড় চাপিয়ে দেওয়া মনে হয়। এ প্রেম আবেগকে নাড়া দিয়ে যায় না। বরং এ সিনেমাটিকে করে তোলে আরও দীর্ঘ। গল্প গল্পের মতো এগোয়, কিন্তু দর্শকেরা যেন এক হতে পারেন না। মনে হয়, কখন সিনেমা শেষ হবে।
চাইলেই এ প্রেমটাকে আরেকটু ভালোভাবে উপস্থাপন করা যেত। আপনি যদি ‘হেমলক সোসাইটি’ সিনেমার ভক্ত হয়ে থাকেন, তবে ‘কিলবিল সোসাইটি’র শেষটা আপনাকে ছুঁয়ে যাবে না। বরং আপনি মৃত্যুকে এনজয় করার চেয়ে আনন্দ করাকেই ভালোবাসবেন, তাকেই মনে হবে কাছের।
সৃজিতের সিনেমার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক সংলাপ। এ সিনেমায়ও দুর্দান্ত সব সংলাপ শুরুর দিকে দেখতে মন্দ লাগছিল না। তবে মুশকিল হলো সিনেমার প্রায় সব চরিত্রই একই ঢঙে, একই ধরনের রসবোধ নিয়ে কথা বলে। একটা সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব চরিত্রই একইভাবে কথা বলে, এটা আবার হয় নাকি!
সিকুয়েল সিনেমা দেখে দর্শক যদি আগের সিনেমার স্তুতি গেয়ে যান, তবে সেটাকে আর যা–ই হোক, খুব ভালো হয়েছে বলা যায় না। ‘কিলবিল সোসাইটি’ দেখার পর তাই ‘আরও ভালো হতে পারত’ আক্ষেপটা থেকেই যায়।
একনজরে
সিনেমা: ‘কিলবিল সোসাইটি’
পরিচালক: সৃজিত মুখার্জি
গল্প ও চিত্রনাট্য: সৃজিত মুখার্জি
স্ট্রিমিং: হইচই
ধরন: রোমান্টিক ড্রামা
রানটাইম: ১ ঘণ্টা ১২ মিনিট
অভিনয়: পরমব্রত চট্টপাধ্যায়, কৌশানী মুখার্জি, বিশ্বনাথ বসু, সন্দীপ্তা সেন, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়
আমারবাঙলা/জিজি