কুষ্টিয়া শহরে যৌথ বাহিনী অভিযানে আটক হওয়া সেই ব্যক্তি দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। তাঁর সঙ্গে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদসহ আটজনকে আটক করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২৭ মে) বেলা সোয়া তিনটার দিকে প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র।
মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় সোনার বাংলা মসজিদের পাশে একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সুব্রত বাইনকে আটক করা হয়। এ সময় তাঁর কাছ থেকে পাঁচটি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১০টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্রটি।
নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অপরাধজগতের আলোচিত নাম ছিল সুব্রত বাইন। আধিপত্য বিস্তার করে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজিতে তাঁর নাম আসা ছিল তখনকার নিয়মিত ঘটনা। এসব কাজ করতে গিয়ে অসংখ্য খুন-জখমের ঘটনাও ঘটেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র বলছে, মূলত নব্বইয়ের দশকে মগবাজারের বিশাল সেন্টার ঘিরেই উত্থান হয় সুব্রত বাইনের। তিনি এই বিপণিবিতানের কাছে চাংপাই নামে একটি রেস্টুরেন্টের কর্মচারী ছিলেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে অপরাধজগতের সঙ্গে জড়িয়ে যান। পরে বিশাল সেন্টারই হয়ে ওঠে তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালনার কেন্দ্র। এ জন্য অনেকে তাঁকে ‘বিশালের সুব্রত’ নামেও চেনেন।
২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর যে নামের তালিকা তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার ঘোষণা করেছিল, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন। তাঁর নামে এখনো ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। সেখানে তাঁর বয়স দেখানো হয়েছে ৫৫ বছর। তাঁকে ধরিয়ে দিতে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
অন্যদিকে মোল্লা মাসুদ ২০১৫ সালে ভারতে ধরা পড়েন বলে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন এবং ভারতেই অবস্থান করেছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছিল।
মোল্লা মাসুদ রাজধানীর মতিঝিল ও গোপীবাগ এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতেন। সুব্রত বাইনের হাত ধরেই মোল্লা মাসুদ অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৩ সালের পরে তাঁকে আর বাংলাদেশে দেখা যায়নি। ভারতে তিনি আবু রাসেল মো. মাসুদ নামে পরিচিত হন। ভারতীয় নাগরিক রিজিয়া সুলতানাকে বিয়ে করে সেখানে বসবাস করছিলেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, মোল্লা মাসুদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে, তার মধ্যে সাবেক সাংসদ কামাল মজুমদারের ভাগনে মামুন হত্যা, পুরান ঢাকায় মুরগি মিলন হত্যা, খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায় ট্রিপল মার্ডার উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অসংখ্য জিডি আছে। ২০০১ সালে তৎকালীন সরকার যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঘোষণা করে, তাতে মোল্লা মাসুদেরও নাম ছিল।
মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকার ওই বাড়িতে গিয়ে বাসিন্দা ও স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন ঘণ্টা ধরে সেখানে অভিযান চালিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এলাকায় অধিকাংশ বাড়িতে মেস ভাড়া দেওয়া হয়। যে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে, সেটির সামনে পৌরসভার সাইনবোর্ডে বাড়ির মালিকের নাম লেখা মীর মহিউদ্দিন। তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার মেসে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ১৮ জন ছাত্র থাকেন।
মেসের কয়েকজন ছাত্রের ভাষ্যমতে, নিচতলায় এই বাড়ির পেছনের বাড়ির এক স্থানীয় বাসিন্দা দুই মাস আগে ভাড়া নেন। ১২ থেকে ১৫ দিন আগে অতিথি পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তিকে রেখে যান। নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন, তা কখনো দেখেননি তাঁরা। তবে একজনকে দিনে দু-একবার শুধু খাবার খাওয়ার সময় বের হতে দেখেন।
ছাত্ররা জানান, মঙ্গলবার ভোর পাঁচটার কিছু সময় পর বাড়ির সামনে সেনাবাহিনীর পাঁচ থেকে ছয়টি গাড়ি আসে। গাড়ির বহরে একটি কালো মাইক্রোবাসও ছিল। ২০ থেকে ৩০ জন সেনাসদস্য বাড়ির তালা খুলতে বলেন। তালা খোলার পর তাঁরা দোতলা ও তিনতলায় ওঠেন। এরপর মেসের সব বাসিন্দাকে দ্বিতীয় তলার একটি ও তৃতীয় তলার একটি কক্ষে রাখেন। এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তোমাদের কোনো ভয় বা সমস্যা নেই। তোমরা বসে থাকো। এখানে অভিযান চলছে।’ সেনা কর্মকর্তা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কথা বলেন বলে ছাত্ররা জানান। দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি ওই মেসে থাকে কি না, সেটি জানতে চান।
প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে নিচতলায় তল্লাশি চলে। আটটার কিছু সময় পর কালো মাইক্রোবাসটি একদম গেটের সামনে চলে আসে। নিচতলা থেকে দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে হাতকড়া পরা ও মাথায় গামছা বাধা অবস্থায় গাড়িতে তোলা হয়। আরেক যুবকের কোমরে ও শরীরে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। এক ছাত্র কৌতূহলবশত জানতে চান, কাকে নিয়ে যাচ্ছেন? তখন একজন সেনা কর্মকর্তা তাঁদের বলেন, ‘এখন বিস্তারিত বললে ভয় পাবা। পরে মিডিয়াতে দেখে নিয়ো।’
আমারবাঙলা/জিজি