পর্ব-১
ঝিনাইদহে বিচারবহির্ভূত ভাবে একাধিক শিবিরের নেতাকর্মী হত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কনক কান্তি দাস, এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দুটি পৃথক মামলায় তাকে ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত, রিমান্ডে থাকাকালীন ঝিনাইদহে কর্মরত একজন সাংবাদিক তার সাথে দেখা করেন,ঐ সাংবাদিককে সাইদুল করিম মিন্টু জানান, ঢাকার বিশেষ গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে ঝিনাইদহের সকল শিবির কর্মী ক্রসফায়ারে মাস্টারমাইন্ড কনক অথচ সব মামলায় আমাকে আসামী করা হচ্ছে। যা ঘটেছিলো, ২০১৬ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছর ঝিনাইদহ এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিনত হয়েছিলো, একের পর এক নিরীহ শিবির কর্মীদের কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছিলো,
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে, ২০১৬ সালের ৭ জুন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মহিষাডাঙ্গা এলাকায় পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীকে (৬৫) গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি করাতিপাড়া গ্রামের সত্যগোপাল গাঙ্গুলীর ছেলে। গোপাল গাঙ্গুলী ছিলেন, নলডাঙ্গা শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত।
পুরোহিত হত্যার ঘটনাকে বাংলাদেশের শীর্ষ মিডিয়া গুলো গুরুত্বসহ প্রকাশ করে, তৎকালীন সরকারের বেশ কয়েক'জন মন্ত্রী আনন্দ গোপালের বাড়িতে যান পরিবারকে শান্তনা দিতে, এরপর মন্ত্রীগণ ও ঢাকা থেকে আসা বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা "বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান" ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও তৎকালীন ঝিনাইদহ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ঝিনাইদহের তথাকথিত হিন্দু অভিভাবক কনক কান্তি দাসের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন, কনক কান্তি দাস ঐ বৈঠকে এই হত্যার দায় শিবিরের দিকে ইঙ্গিত করেন, এরপর গোয়েন্দা সংস্থা শিবির কে টার্গেট করে মাঠে নামে ,ঘটনার ৯ দিন পর ১৬ জুন রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির একটি বাসা থেকে সাদাপোশাকের লোকজন পুলিশ পরিচয় দিয়ে ঝিনাইদহ শিবিরের শহর শাখার সাবেক সভাপতি ইবনুল ইসলাম ওরফে পারভেজ সহ শিবিরের আরো দুই কর্মী শহীদ আল মাহমুদ ও আনিচুর রহমান কে গ্রেফতার করে, উক্ত তিন শিবির নেতাকর্মীর গ্রেফতারের বিষয়টি পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তাদের পরিবারের নিকট অস্বীকার করে, এর মধ্যে নাটকীয় ভাবে
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উত্তর কাষ্ট সাগরা গ্রামের শ্রীশ্রী রাধামদন গোপাল বিগ্রহে (মঠ) এর সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস ১ জুলাই শুক্রবার ভোরে পূজার জন্য ফুল তুলতে গেলে দূর্বৃত্তের হাতে নিহত হন, ঐদিকে একই সময়ে ১ জুলাই শুক্রবারে ভোরে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া গ্রামের মাঠে পারভেজ এর সাথে তুলে আনা শিবির কর্মী শহীদ আল মাহমুদ ও আনিচুর রহমান কে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরের দিন শনিবার ভোরে সদর উপজেলার আড়ুয়াকান্দিতে একটি কবরস্থানের পাশে ইবনুল ইসলাম পারভেজ কে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ মাধ্যমে হত্যা করা হয়, ঘটনাস্থলের কাছেই আগের দিন শুক্রবার ভোরে মঠের সেবায়েত শ্যামানন্দকে হত্যা করা হয়েছিলো,
পারভেজ ঝিনাইদহ শহরের বনানীপাড়ার জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে। ইসলামী ছাত্রশিবিরের শহর শাখার সাবেক সভাপতি ছিলেন।
পারভেজের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেন সেই সময় গণমাধ্যম কে জানিয়েছিলেন , গত ১৬ জুন রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির একটি বাসা থেকে সাদাপোশাকের লোকজন পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাঁর ছেলে পারভেজকে তুলে নিয়ে যান। সেই থেকে তিনি ১৭ দিন নিখোঁজ ছিলেন। শনিবার সকালে তাঁকে জানানো হয়, পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পারভেজ নিহত হয়েছেন।
এই ঘটনায় কনক কান্তি দাসের লাভ কি?
কনক কান্তি দাস ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত ঝিনাইদহের গুরুত্বপূর্ণ কোন নেতা ছিলেন না, রাজপথের রাজনীতিতেও তিনি ছিলেন না সক্রিয়, মামলা হামলা, জেল জুলুমের স্বীকার তিনি কখনো হননি, আওয়ামীলীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায়ও কোন মিছিলের সামনে তাকে দেখা যায়নি তবে তিনি সংখ্যালঘুদের সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাথে ছাত্র জীবন থেকেই জড়িত ছিলেন, ঝিনাইদহের পূজা উদযাপন পরিষদের সাথেও তিনি ছিলেন ছাত্র জীবন থেকেই, পড়াশোনা শেষে তিনি হাটের রাস্তায় পাটের ব্যবসা শুরু করেন, এর মধ্যে পুলিশ লাইনের মেস এর জ্বালানির জন্য লাকড়ি খড়ি দিয়ে তিনি পুলিশের সাথে ব্যবসায় জড়ান, খড়ির বিল নেওয়ার জন্য পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাড়িয়ে থাকার রেকর্ড আছে তার, খড়ির ব্যবসার সূত্র ধরে পুলিশ সুপারের সাথে সম্পর্ক ভালো হলে তিনি পুলিশের রেশনের জন্য মসুরের ডাল সহ আরো কয়েকটি পন্য সরবরাহের কাজ বাগিয়ে নেন, পর্যায়ক্রমে আসেন ঠিকাদারি ব্যবসায়, এখানে তিনি সফল হন অল্প সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন, সরাসরি রাজনীতি না করলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন আওয়ামীলীগের একজন ডোনার, দলের বিভিন্ন প্রোগামে তিনি টাকা দিতেন,
এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে শফিকুল ইসলাম অপু ঝিনাইদহ ২ আসনে এমপি নির্বাচিত হন, ঝিনাইদহের পূর্বের আওয়ামীলীগের নূরে আলম সিদ্দিকীর সেটাপ ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, এরপর তিনি ভারতীয় হাইকমিশনারের সুপারিশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান, যদিও ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগের শীর্ষ কোন নেতা"ই এটা সমথর্ন করেনি! এরপর ২০১৪ সালে তিনি পুনরায় ভারতীয় হাইকমিশনের সুপারিশে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান কিন্তু সেবার স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আব্দুল আলিম এর নিকট ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে ফেল করেন, সেই সময় তিনি ভোটের রেজাল্ট উল্টে দেবার জন্য তৎকালীন ডিসিকে ২কোটি টাকার প্রস্তাব দেন, ডিসি রাজি না হলে ডিসির বিরুদ্ধে তিনি মাইকিং করে জনসভা আহবান করে ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলেন। এরপরই তিনি নতুন খেলায় মনোযোগ দেন, ঝিনাইদহের যে কোন একটা চেয়ার তার লাগবে কিন্তু স্থানীয় আওয়ামীলীগ তাকে কোন সহযোগিতা করবে না এটা তিনি বুঝতে পারেন, তখনই ঝিনাইদহে সংখ্যা লঘু নির্যাতন হচ্ছে এই ব্যাপারটি তিনি জাতীয় ভাবে আনার চেষ্টা করেন যেন এখানে হিন্দুদের ক্ষমতায়ন করা হয়, এরপর ঝিনাইদহে একের পর এক সংখ্যালঘু হত্যার ঘটনা ঘটে! পুরো ঝিনাইদহ তখন দেশবাসীর সামনে চলে আসে, এরমধ্যে ১৬ সালে অক্টোবর মাসে জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয় সরকার, কেন্দ্র থেকে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগ এর কাছে চাওয়া হয় তালিকা ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামীলীগ যে তালিকা পাঠায় সেখানে কনক কান্তি দাসের নাম ছিলো না তবুও তিনি পেয়ে যান মনোনয়ন, ভারতীয় সুপারিশ, সংখ্যালঘু ক্ষমতায়ন এক কথায় হিন্দু কোটায় নমিনেশন পেয়েছেন এমন আলোচনা তখন শহরের সর্বত্র। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় সেই ভোটে তিনি জয় লাভ করেন! ২০২২ সালেও তিনি জেলা পরিষদের মনোনয়ন পান, তবে প্রশাসনের সহযোগিতা না পাওয়ায়ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়ায় সেই ভোটে তিনি ফেল করেন, ফেল করেও তিনি চুপ করে থাকেননি, তার ব্যবহৃত অবৈধ অস্ত্র দিয়ে তার ব্যক্তিগত ড্রাইভার বিশ্বজিৎ শর্মার পেটে গুলি করিয়ে বিরোধীদের ফাঁসাতে চেয়েছিলেন কিন্তু সিসি ফুটেজে পুরো বিষয়টি ধরা পড়ায় বিশ্বজিৎ নিজেই ফেঁসে যান, বিশ্বজিৎকে গ্রেফতার করে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিশ্বজিৎ স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেন তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্র।
এই পুরো ঘটনা নিয়ে জেলা পুলিশ প্রেস ব্রিফিং করতে চাইলে কনক কান্তি দাস সেটি ঠেকিয়ে ছিলেন।
এরপরই সাদা মনের মানুষ সেজে থাকা কনক কান্তি দাসকে অনেকেই সন্দেহ করতে থাকেন যে পুরোহিত আনন্দ গোপাল ও সেবায়েত শ্যামানন্দ দাস কে কনক কান্তি দাস নিজেই হত্যা করিয়েছেন।
শিবির হত্যার সন্দেহের বাইরে তিনি কিভাবে ছিলেন?
আস্তে আস্তে কথা বলা ভদ্রলোক সেজে থাকা চরম ঠান্ডা মাথার উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক কনক কান্তি দাস অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ, তার পিএস থেকে ড্রাইভার, ম্যানেজার চাকরবাকর সবাই হিন্দু, কোন মুসলমান কর্মচারী তিনি নিয়োগ দেননা, আওয়ামীলীগের পুরো ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি ১১ বছর জনপ্রতিনিধি ছিলেন, এই এগারো বছরে কোন দাঁড়ি-টুপি পরা কোন ব্যক্তি তার নিকট কোন কাজ নিয়ে গেলে তিনি তাদের কখনো খালি হাতে ফেরত দেননি, যদিও খুব কম মানুষ গিয়েছে তবে তারা বাইরে এমন প্রচার করেছে যে কনক কান্তি দাস একজন ভালো মানুষ।
ঝিনাইদহে আরো যারা শিবির হবার কারণে ক্রসফায়ারে নিহত হন,
২০১৬ সালের ১২ আগস্ট হরিণাকুন্ডুর জোড়াপুকুরিয়া গ্রামে মাদরাসা শিক্ষক পান্না হুজুর একই বছর ২৫ অক্টোবর ঝিনাইদহ শহরের বাইপাস সড়কে কথিত বন্দুক যুদ্ধে জামায়াত নেতা জহুরুল ইসলাম ও ডা. তারিক আল হাসান নিহত হন। এছাড়াও শৈলকূপা, কোটচাঁদপুর, কালীগঞ্জে একাধিক শিবির নেতাকে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়।
এ ব্যাপারে কনক কান্তি দাসের বক্তব্য জানার জন্য তাকে ফোন করা হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায় ।
আমার বাঙলা/ ইউকে
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            