রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও, 'জুলাই সনদ' বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ কমিটির দ্বারস্থ হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সুপারিশে সরকারি আদেশের ভিত্তিতে গণভোটের মাধ্যমে সনদটি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে, যা বর্তমানে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই প্রস্তাব নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন রাজনৈতিক ও বিশেষজ্ঞ মহল।
সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের 'নোট অব ডিসেন্ট' বা ভিন্নমতকে উপেক্ষা করে তৈরি এই বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তুলেছে অন্যতম প্রধান দল বিএনপি। মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সুপারিশ ও খসড়া বাস্তবায়ন আদেশ হস্তান্তরের পর দলটির নেতাদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ও কঠোর প্রতিক্রিয়া এসেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বাতলে দেওয়া জুলাই সনদ বা রাষ্ট্রীয় সংস্কার বাস্তবায়নের পদ্ধতি দেশে নতুন কোনো সংকটের সূচনা করল কিনা, সেই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক বিশ্লেষক। তাঁরা সরকারকে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের আগে দলগুলোর আনুষ্ঠানিক সম্মতি আদায়ের মাধ্যমে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান মনে করেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের এই আদেশ নতুন করে রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে। তাঁর মতে, এর মাধ্যমে এমনকি গণভোটও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
তিনি মন্তব্য করেন, "এখন যে অবস্থায় আদেশটিকে নিয়ে আসা হয়েছে, যদি রাজনৈতিক দলগুলোকে একমত করানো যায়, তবে এটা সরকারের সফলতা হবে। আর যদি একমত না করানো যায়, তাহলে সরকারও দুর্বল হয়ে পড়বে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে এবং গণভোটটিও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে।"
জুলাই সনদ সই হওয়ার মাত্র ১২ দিনের মাথায় মঙ্গলবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে ঐকমত্য কমিশন। এতে কমিশন জুলাই সনদে আসা সংবিধান সংস্কারের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য দুটি বিকল্প পদ্ধতির প্রস্তাব করে।
কমিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫'-এ সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে সরকার এই দুটি বিকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে বাস্তবায়ন ও আইনগত ভিত্তি দিতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এসব সুপারিশ প্রকাশিত হওয়ার পর জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। সংবিধান সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি সুপারিশে যুক্ত না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় বিএনপির তরফে।
এর প্রতিক্রিয়ায় আপত্তির কথা বলেছেন জুলাই সনদ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত থাকা সিপিবির এক নেতাও।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের যে বিষয়টা মূল ছিল, সেটা হল রাজনৈতিক দলগুলো যেগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেগুলো ঠিক করেছে, সেগুলো নিয়ে গণভোটে যাওয়ার কথা। আর যেগুলো একমত হয় নাই, সেগুলো হচ্ছে নোট অব ডিসেন্ট আকারে থাকবে।
“কিন্তু গণভোটের ব্যাপারে যেটা দেওয়া হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে কিন্তু জুলাই সনদটার ব্যাপারে একমত কিনা, ‘হ্যাঁ-না’ অর্থে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এখানে আর নোট অব ডিসেন্ট আর থাকছে না। সরাসরি এগুলো চলে আসছে। তো এখানে যে বিভেদটা আমরা চিন্তা করেছিলাম এক বছর আগে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমি একবছর ধরে যে কাজগুলো হলো, সেই কাজগুলোর তেমন অর্থ থাকল না।”
তিনি বলেন, “ঐকমত্য কমিশন যেভাবে চিন্তা করেছিল, যে প্রস্তাবগুলো এনেছিল সেগুলোই সামনে এসেছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিভেদ তৈরি হয় কিনা, নতুন করে জাতীয় ঐক্যে কোনো ফাটল ধরে কিনা সেটাই হলো জুলাই সনদের বর্তমান উপস্থাপনার মূল চ্যালেঞ্জ। এতে গণভোটটাও আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেল। গণভোটে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনটা কেমন- কীভাবে থাকবে, সেটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল।
“এর মাধ্যমে একটা বিভেদ তৈরি হবে, একটা বিতর্ক তৈরি হবে যে, আমরা এভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছিলাম এখন আমরা অন্যভাবে সিদ্ধান্তে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান কী হবে, নতুন করে আমাদের জানতে হবে।”
এক্ষেত্রে জুলাই সনদ পাস করার ক্ষেত্রে জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তি সবার সমর্থন পাবে কিনা, সেই অনিশ্চয়তাও তৈরি হল বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মাহবুব।
এর মাধ্যমে রাজনীতিতে বিভাজন আগের মত স্পষ্ট হলে সঙ্কটও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, “আমাদের যে রাজনৈতিক বিভাজন, রাজনীতির বিভাজন- সেটা সেই একদম আগে থেকেই ছিল, এখন পর্যন্ত আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে আমার মনে হয়। আমরা ওই নিজস্ব অবস্থান থেকে সরতে পারব না। দেশের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে দেশের মানুষের স্বার্থে তো আমরা এক জায়গায় যেতে পারব না কখনো, এতটাই বিভাজিত আমরা।”
তিনি বলেন, “ঐকমত্য না থাকায় রাজনৈতিক বিভাজন একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে। সংকটতো হতেই পারে, যেহেতু একটা বিভাজন থেকেই গেল। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো কিছু বিষয়ে একমত আছে। কিন্তু নির্বাচন, গণপরিষদ, গণভোট, আপার হাউজ, লোয়ার হাউজ, পিআর এসব বিষয় নিয়ে একমত হতে পারল না।
“এবং শুরু থেকে এটা ছিল। এত আলাপ, এত আলোচনা, এত বৈঠক, এত সভা, এত আলোচনা- এটা কিন্তু এখান থেকে কিন্তু সরতে পারেনি। ভবিষ্যতে যে আর ঐকমত্য হবে এটার নিশ্চয়তা নেই। আর নিশ্চয়তা না থাকে, ভিন্নমত যদি হয় তখন তো পরিস্থিতি অন্যরকম হতেই পারে।”
গণভোটের বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় এক ধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মন্তব্য করে এই বিশ্লেষক বলেন, “যে সুপারিশটা তারমধ্যেও কিন্তু পরিষ্কার মানে নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা নাই। অর্থাৎ এখানে এক ধরনের অনৈক্য রয়ে গেছে। যেটা শুরুতে ছিল সেটা এই চূড়ান্ত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মধ্যেও রয়েই গেল। অর্থাৎ এটার কোনো সুরাহা হল না।”
দুই বিকল্প দিয়ে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ জারি এবং এর আলোকে গণভোট ও সংবিধান সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে।
একটি প্রস্তাবে কমিশন বলেছে, “জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয়গুলো কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সরকার ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ ২০২৫’ শিরোনামে একটি আদেশ জারি করবে।
“জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ওই আদেশ এবং তার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার প্রণীত একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে।”
তফসিল-১ এ থাকছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় আসা সংবিধানের ৪৮টি সংশোধন প্রস্তাব। ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষর হওয়া জুলাই সনদে এই সংশোধনীগুলোর বিভিন্ন অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও তফসিলে তা রাখা হয়নি।
বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একইসঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হওয়ার কথা বলেছে কমিশন। এ পরিষদ সংবিধান সংস্কার বিষয়ে ‘গাঠনিক ক্ষমতা’ প্রয়োগ করতে পারবে।
কমিশন বলেছে, “বাস্তবায়ন আদেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায় তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করবে।
“তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।”
আরেকটি প্রস্তাবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারির মাধ্যমে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে ‘পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল’ এর বিষয়টি বাদ রাখা হয়েছে। তবে ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা দ্বিতীয় বিকল্পেও রাখা হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত আদেশে গণভোট কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদের গঠন ও কার্যাবলি তুলে ধরা হয়েছে।
খসড়া আদেশে বলা হয়েছে, “এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা উক্ত নির্বাচনের দিন এই আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা হইবে।”
আদেশে বলা থাকবে, “জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত অংশ গণভোটে উপস্থাপন করা হইবে।”
গণভোটের ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে, “আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?”
খসড়া আদেশে বলা হয়, গণভোটে উপস্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে প্রদত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ইতিবাচক বা হ্যাঁ সূচক হইলে এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হইবে, যাহা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার) প্রয়োগ করিতে পারিবে।
“উক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ একইসাথে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসাবে এবং এই আদেশ অনুসারে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করিবেন।
“পরিষদ উহার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হইতে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এই আদেশের তফসিল-১ এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করিবে এবং তাহা সম্পন্ন করিবার পর পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হইবে।”
জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একইসঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবেও শপথ করবেন, এমন বিধান খসড়া আদেশে রেখেছে ঐকমত্য কমিশন। তাদের শপথবাক্যও নির্ধারণ করা হয়েছে আদেশের দ্বিতীয় তফসিলে।
খসড়া আদেশে বলা হয়েছে, “নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সংসদ-সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের পর একই শপথ অনুষ্ঠানে এই আদেশের তফসিল-২ অনুযায়ী পরিষদ-সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা (এই অনুচ্ছেদে ‘শপথ’ বলিয়া অভিহিত) করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন।”
সংবিধান সংস্কার পরিষদ সংশোধনীগুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার পর বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ২৭০ দিন পর সংস্কার বাস্তবায়ন হয়ে গেলে পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) উচ্চ কক্ষ গঠনের কথা বলা হয়েছে আদেশের খসড়ায়।
সেখানে বলা হয়েছে, “উচ্চকক্ষের মেয়াদ শপথ গ্রহণের তারিখ হইতে এই আদেশ জারির অব্যবহিত পরে গঠিত নিম্নকক্ষের (জাতীয় সংসদের) মেয়াদের শেষ দিবস পর্যন্ত হইবে।”
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে ইতিবাচক ফল না এলে কী হবে, এমন প্রশ্নে জনগণের উপর আস্থা রাখার কথা বলেছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
মঙ্গলবার এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “গণভোটে পাস না হলে গণভোট পাস হবে না। তার মানে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে।”
লাতিন আমেরিকার দেশ চিলিতে সংবিধান নিয়ে দুইবার গণভোট ব্যর্থ হওয়ার উদাহরণ টেনে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, “প্রথমবার চিলিতে একটা সংবিধান তৈরি করে দেওয়া হল গণভোটে, সেটা হারল। কেউ কেউ বললেন, এটা অনেক বেশি দক্ষিণপন্থি হয়ে উঠেছিল অথবা বামপন্থি হয়ে উঠেছিল। একেকজনকে একটা বলল।
“তারপর আবার এটা সংশোধন-সংযোজন করা হয়, করে আবার গণভোটে দেওয়া হয়েছিল। আবারও ফেল করেছে। পাস না করলে তার মানে হচ্ছে যে, জনগণ তাহলে গ্রহণ করছেন না। এইজন্য আমি বলছি আবার, জনগণের উপর আস্থা রাখুন।”
সংবিধান সংশোধন বিষয়ক ৪৮টি প্রস্তাব ‘প্যাকেজ আকারে’ গণভোটের জন্য থাকবে বলে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান তিনি।
তিনি বলেন, যেকোনো গণভোটের ক্ষেত্রে এক অথবা দুইটা প্রশ্ন থাকে। কোথাও একটু বেশিও হয়েছে। আইসল্যান্ডের ক্ষেত্রে সম্ভবত উদাহরণ আছে যে ছয়টা প্রশ্ন ছিল।
“কিন্তু আমাদের সুপারিশ হচ্ছে একটা প্যাকেজ হিসেবে একটি প্রশ্ন যে, ‘আপনি এই আদেশ এবং এই আদেশের তফসিলে যে বিষয়গুলো সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত আছে তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করছেন কিনা‘।”
প্যাকেজের কোনো অংশের উপর একমত এবং অন্য অংশের উপর ভিন্নমতের হিসাব কীভাবে হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আপনি যে আশঙ্কার কথা বলছেন যে, এটার জন্য এটা হবে, ওটার জন্য ওটা হবে। যেকোনো রেফারেন্ডামের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা থাকে। আমি তুরস্কের ২০১৬ সালের রেফারেন্ডমের উদাহরণ দিয়েছি, ওখানে ২১টি বিষয় ছিল এবং সেটি অত্যন্ত মার্জিনালি জিতেছিল, ৫১% মাত্র।
“সেক্ষেত্রে হতে পারে যে, ওই ২১টি বিষয়ের মধ্যে কেউ কেউ একটি বিষয়ে একমত, ১৯টি বিষয়ে ২০টি বিষয়ে একমত। তারপর ভোট দিয়েছেন কীভাবে দিয়েছেন, আমি জানি না।”
আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশে অতীতে এরকম নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোর উদাহরণ আমি দিচ্ছি না, বিভিন্ন কারণে। কিন্তু পৃথিবীতে বাংলাদেশই প্রথম গণভোট করবে না যেখানে একটিমাত্র প্রশ্ন দিয়ে অনেক বিষয়কে ক্যাপচার করার চেষ্টা হচ্ছে।”
৪৮টি বিষয় একই প্যাকেজে আনাটা গণভোটের প্রশ্ন হিসাবে জটিল হয়ে যাবে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “যেকোনো গণভোট সাধারণত এক বা দুটো প্রশ্ন হয়, ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়ে বেশি হয়েছে। দুয়েকটি, পাঁচটা বা ছয়টা প্রশ্ন ছিল।
“কিন্তু এযাবৎকালে ১৭৮৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যে তথ্য বা গবেষণার বিষয়গুলো আমার কাছে জানা আছে, তার উপর ভিত্তি করে আমি বলতে পারি, অধিকাংশ প্রশ্ন আসলে একটা।”
এক বা দুই প্রশ্ন হলেও এর পেছনে অনেক প্রশ্ন থাকে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমি একটু উদাহরণ দিলে আপনি বুঝতে পারবেন। ২০১৬ সালে তুরস্কে যে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেটা প্রশ্ন একটাই ছিল। কিন্তু সেই এক প্রশ্নে ২১টি বিষয়ে সংশোধনের কথা বলা হয়েছে।
“তাহলে এই যে, আপনি বা আমি-আমরা যদি মনে করি যে জনগণ এগুলো বুঝতে পারবেন না। জনগণের উপর আস্থা রাখুন, বাংলাদেশের জনগণের উপর আস্থা রাখুন। বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, বাংলাদেশের মানুষ নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদী শাসনকে প্রতিরোধ করেছে এবং যখনই সুযোগ তৈরি হয়েছে তখন নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় তারা তাদের রায় দিতে পেরেছে।”
জনগণ বুঝতে পারবে না, এমন কথা বললে নিজের অস্বস্তির কথা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, “যখন কেউ আমাকে বলেন যে, জনগণ এটা বুঝবেন না। আমি এটাতে খুব অস্বস্তিবোধ করি, ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব অস্বস্তিবোধ করি।
“বোঝাবার ক্ষেত্রে সরকারের একটা দায়িত্ব আছে। আমি বোঝাবার অর্থে বলছি না, আমি বলছি সরকারের দায়িত্ব হবে এগুলো (গণভোট বিষয়ক প্রশ্ন) যতটা দ্রুত সম্ভব, যতটা সহজলভ্য করে যেভাবে হোক প্রত্যেকের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। আজকে আমরা যখন সুপারিশটা সরকারকে দিয়েছি, সেখানে এটা আমরা সুস্পষ্টভাবে, অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বলেছি, এটা আপনারা করবেন, এটা আপনাদের কাজ।”
মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ বাস্তবায়নে পদ্ধতি সরকারের কাছে জমা দেওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন জুলাই সনদ প্রণয়ন নিয়ে বিএনপির তরফে আলোচনায় থাকা সালাহউদ্দিন আহমদ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘নিষ্কৃতি’ পাওয়ার জন্য আলোচনা ও সিদ্ধান্ত ‘বহির্ভূত’ বিষয় সংযুক্ত করে সুপারিশ জমা দিয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।
সুপারিশ জমা দেওয়ার জন্য ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের ক্ষোভ ও হতাশার কথাও বলেছেন তিনি।
‘নোট অব ডিসেন্ট’ যুক্ত না করায় বিস্ময় প্রকাশ করে সালাহউদ্দিন বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদের ৮৪টি দফার মধ্যে অনেকগুলোতে বিভিন্ন দলের ভিন্নমত রয়েছে। নোট অব ডিসেন্টগুলো বিস্ময়করভাবে আজকের সংযুক্তিতে উল্লেখ নেই।”
সুপারিশে থাকা ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ এর ধারণা নিয়েও কোনো বৈঠকে ‘আলাপ বা সিদ্ধান্ত হয়নি’ বলে তুলে ধরেন তিনি।
সালাহউদ্দিন বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ নামে নতুন একটি ধারণা এখানে যুক্ত করা হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের টেবিলে এটা কখনও আলোচিত হয়নি। আসন্ন নির্বাচনটা হবে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। সেই সংসদ সদস্যরা যদি সংবিধান সংস্কারের কার্যক্রম পরিচালনা করে সেটা তো জাতীয় সংসদেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
“জাতীয় সংসদ কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচিত হয়নি। হঠাৎ করে এই সিদ্ধান্ত ওনারা আরোপ করতে পারেন না।”
বর্তমানে গণভোট আয়োজনের সংবিধানিক পথ না থাকার কথা তুলে ধরে এই বিএনপি নেতা বলেন, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার কথা। সংবিধান সংস্কারের কথা না। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজন। হ্যাঁ, জুলাই জাতীয় সনদ গণভোটের মাধ্যমে যদি জনগণের মেন্ডেট পায় তাহলে সে অনুযায়ী সংবিধান পরিষদ গঠন হতে পারে। কিন্তু জুলাই জাতীয় সনদ গণভোটে যাবে যেভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেভাবে।”
সংসদের নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষে পিআরের সংখ্যানুপাতের (পিআর) বিষয়টিও ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদে আসেনি দাবি করে তিনি বলেন, “এখানে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতিক হারে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এই রকম কিছু তো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। এখানে পিআর এর ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠনের কথা বলে দিয়ে তারা নাকি এটা গণভোটে পাঠাবে। এভাবেতো সিদ্ধান্ত হয়নি।
“আরো একটি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তারা ২৭০ দিন সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গৃহীত না হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে সংযুক্ত হবে। এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। অটোপাসের মতো কোনো বিষয় সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এল আমি জানি না।”
বাস্তবায়ন আদেশ থেকে জুলাই সনদের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তুলে দেওয়ায় ‘নতুন সংকট’ তৈরি হল বলে মন্তব্য করেছেন সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “এ বিষয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটকে আমরা অপ্রয়োজনীয় মনে করেছি। প্রস্তাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের আলোচনা তোলার মধ্য দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ও তার প্রস্তুতিকে ব্যাহত করবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।
“'সংবিধান সংস্কার পরিষদের' কথা কেন বলা হল তা বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে তো ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা বা কোনো ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। সংবিধান সংস্কার পরিষদের প্রয়োজন মনে করছি না।”
তার ভাষ্য, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া গেছে এবং সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে জড়িত সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সংসদকে আলোচনার ভিত্তিতে একটা সময় বেঁধে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের আলোচনা আরো গভীরভাবে হওয়া প্রয়োজন। এজন্য মাত্র ৪৫ দিন সময় সময়ে দেওয়া যথাযথ নয়।
প্রিন্স বলেন, “এই মুহূর্তে প্রধান কাজ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কোনোভাবেই এ কাজকে ব্যাহত করা যাবে না। সহজ সমাধানকে জটিল না করে আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, আলোচনা ও অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলগুলো যার যার বিবেচনা অনুযায়ী অঙ্গীকার করেছে।
“জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ইশতেহারে আরও সুনির্দিষ্টভাবে অঙ্গীকার করবে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থা রাখা আর বিচারের ভার জনগণের উপর ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক দল কথা না রাখলে জনগণ তার বিচার করবে।”
এদিকে জাতীয় জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ছয় ধাপের রূপরেখা তুলে ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আবারও জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজনের দাবি করেছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারির নেতাদের নিয়ে গঠিত দলটি বলছে, অভ্যুত্থানের দাবি অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের গণভোট আগে হলে পরবর্তী নির্বাচনেই বেশকিছু সংস্কার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
অপরদিকে জামায়াতে ইসলামীও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে নভেম্বরের মধ্যে গণভোট আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে। মঙ্গলবার ঐকমত্য কমিশনের ব্রিফিংয়ের আগে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে এটিসহ মোট ১৮টি দাবি জানিয়ে এসেছে দলটি।
পরে দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকটি হয়েছে অত্যন্ত খোলামেলা, আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে। প্রতিটি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। কমিশন আমাদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন ও কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
“আমরা তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্তুষ্ট। আমরা লিখিতভাবে আমাদের ১৮ দফা দিয়েছি, বলেছি এর বাস্তবায়ন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।”
গোলাম পরওয়ার বলেন, “১৮ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম হলো–জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করতে হবে এবং তা আগামী নভেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে। কারণ জনগণকে ভোটের আগে জাতীয় সনদে প্রস্তাবিত কাঠামোগত পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে হবে।”
তিনি বলেন, “একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে কারিগরি ও নিরাপত্তাজনিত জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই গণভোট আলাদা সময়ে আয়োজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।”
আমারবাঙলা/এফএইচ