জুলাই গণ–অভ্যুত্থান দিবসে ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন, তা নিয়ে মনঃক্ষুণ্ণ হলেও কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায়নি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে তারা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের পদ্ধতির ব্যাপারে এনসিপি ছাড় দিতে রাজি নয়।
এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ পাঁচজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এই মনোভাবের কথা জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, জুলাই সনদের বিষয়টি সুরাহা হওয়ার পর তাঁরা নির্বাচনমুখী কার্যক্রমে মনোযোগ দেবেন।
এনসিপি মনে করে, জুলাই ঘোষণাপত্র, নির্বাচনের সময় নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির চাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছে সরকার। এখন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিএনপি যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য দলটির ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে চায় এনসিপি।
এরই অংশ হিসেবে এনসিপির কোনো কোনো নেতা জাতীয় নির্বাচনের ঘোষিত সময়সীমা নিয়ে ভিন্ন সুরে বক্তব্য দিচ্ছেন। দলটি চাইছে বিএনপি জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়ে দ্রুত সম্মত হোক। এনসিপির একটি সূত্র জানায়, তারা জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে যে বিশেষ শোরগোল করেনি, সেটা তাদের দিক থেকে একধরনের ‘ছাড়’। এর মধ্য দিয়ে বিএনপিকে একটা বার্তা দিয়েছে তারা, যাতে বিএনপি জুলাই সনদ প্রশ্নে অন্য দলগুলোর চাওয়াকে গুরুত্ব দেয়।
এনসিপির নেতাদের ভাষ্য, অতীতে দেখা গেছে, একচ্ছত্র ক্ষমতার কারণে সরকারি দল বিরোধ দলগুলোকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে ফেলে। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই ধারায় পরিবর্তন আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পাশাপাশি অন্তত সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতি চালু হলে দেশে একটা ন্যূনতম রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি হতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত হলো সংসদের উচ্চকক্ষ হবে ১০০ আসনবিশিষ্ট। এই সদস্যরা মনোনীত হবেন পিআর পদ্ধতিতে। যদিও এ বিষয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের ভিন্নমত আছে।
যদিও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে বিএনপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে দলটির নেতারা বলে আসছেন। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ভিন্নমতের কারণে উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি শেষ পর্যন্ত সম্মত হবে কি না, এ নিয়ে সংশয় আছে এনসিপির। এ জন্য তারা বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে। এই ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের অবস্থানও প্রায় একই রকম।
এ বিষয়ে রাজনীতিবিষয়ক লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, এগুলো একেক দলের রাজনৈতিক অবস্থান। প্রতিটি দলই নির্বাচনী দৌড়ে আছে। এ জন্য তারা পরস্পরকে চাপে রাখবে, এমনকি সরকারকেও চাপে রাখবে, এটা স্বাভাবিক। তিনি বলেন, আজকে এনসিপি যদি মনে করত তারা নির্বাচন করে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০ আসন পাবে, তারা পিআরের পক্ষে বলত না। আবার বিএনপি যদি মনে করত তারা ৭০ আসন পাবে, তারা পিআরের পক্ষে বলত।
‘তবে ভোটারের মতামতের প্রতিফলনটা আমরা গতানুগতিকভাবে যেভাবে দেখে আসছি, সেটার একটু পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়’ বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
হঠাৎ ভিন্ন বক্তব্যের নেপথ্যে
এনসিপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা। কিন্তু বিএনপির মূল মনোযোগ কেবল নির্বাচনকেন্দ্রিক। এনসিপির কেউ নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক কিছু বললে বিএনপি সেটার পেছনে ষড়যন্ত্র খোঁজে, শঙ্কিত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমন পরিস্থিতিতে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে বিএনপিকে নমনীয় করতে নির্বাচন নিয়ে প্রায়ই ভিন্ন সুরে বক্তব্য দিতে দেখা যায় এনসিপির নেতাদের। গত মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন,‘বর্তমান সময়ে ইলেকশনের ডেট ঘোষণা হয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়, আমার যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল সংস্কারের জন্য, একটি নতুন সংবিধানের জন্য, তাহলে কবরে গিয়ে তার লাশটা ফেরত দিতে হবে এই সরকারকে।’
একই অনুষ্ঠানে নাসীরুদ্দীন ও এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরেরও (ডিজিএফআই) কড়া সমালোচনা করেন। হাসনাত আবদুল্লাহ ডিজিএফআইয়ের সংস্কারের দাবি জানান। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটিকে নিষিদ্ধ করে দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন।
এনসিপি নেতারা জানান, সম্প্রতি হাসনাত, নাসীরুদ্দীনসহ এনসিপির পাঁচ নেতার কক্সবাজার সফর নিয়ে যে গুজব ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটার জন্য তাঁরা ডিজিএফআইকে সন্দেহ করেন। তাঁদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে বলেও তাঁরা মনে করেন। এসব ক্ষোভ থেকে মঙ্গলবার এমন বক্তব্য এসেছে বলে দলীয় সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।
নির্বাচনী চিন্তা
এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগেই মাঠপর্যায়ে নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে চায় বলে এনসিপির নেতারা জানিয়েছেন। জুলাই মাসজুড়ে সারা দেশে জেলায় জেলায় যে পদযাত্রা করেছেন, সেটার মাধ্যমে এনসিপির সমর্থন কোথায় কেমন, সে বিষয়ে একটি ধারণা পেয়েছেন দলের নেতারা। পদযাত্রায় ভালো সাড়া পাওয়া গেছে, এমন দুই শতাধিক উপজেলায় শিগগিরই সমাবেশ করার চিন্তা করছে দলটি। এর মধ্য দিয়ে ভোটের প্রস্তুতিতে ঢুকতে চায় তারা।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গত বুধবার বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়টি সুরাহা হওয়ার পর আমরা নির্বাচন নিয়ে ভাবব।’
আমার বাঙলা/জিজি