সকল জটিলতা পেরিয়ে সরকার ও মুসল্লিদের যৌথ উদ্যোগে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদকে দৃষ্টিনন্দন মসজিদে করার ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ডক্টর অ. ফ. ম খালিদ হোসেন। এই ছাড়া মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দকৃত দশ কোটি টাকা হস্তান্তরের ঘোষণা দেন তিনি।
গতকাল রবিবার (১২ অক্টোবর) ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটির পুন:নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই ঘোষণা দেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। এই মসজিদ নির্মাণে যে কোন অবস্থায় যেকোনো সময় পাশে থাকার আশ্বাস দেন এবং এই মহৎ কাজে সবাইকে পাশে থাকার অনুরোধ করেন তিনি ।
এদিকে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ক্যান্সার ইউনিট স্থাপনে বিশেষ অবদান রাখায় দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেকের প্রশংসা করে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সিটি মেয়র ডাক্তার শাহাদাত হোসেন বলেন, আমি মনে করি চট্টগ্রামের মহৎ মানুষ গুলো পাশে থাকলে এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ কে দৃষ্টিনন্দন মসজিদে পূর্ণ নির্মাণ করা অসম্ভব কিছু নয়।
এই ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদের আধুনিকায়নে পুনঃনির্মাণ কাগজে কলমে নয় যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারসহ সকলের সহযোগিতা চেয়ে মসজিদের খতিব হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন তাহির জাবেরী আল মাদানী বলেন, এই মসজিদে আমি ৩০ বছর ধরে আছি। আমার মতে এখানকার মানুষ অনেক বড় মনের। সবার আন্তরিক সহযোগিতা থাকলে দৃষ্টিনন্দন মসজিদে পুণ:নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, মানুষ যা চায় তা পারে, চট্টগ্রামবাসী এ পর্যন্ত কোন প্রজেক্ট হাতে নিয়ে ফেল করেনি। ধর্ম উপদেষ্টা নিশ্চয় আমাদের পাশে থাকবেন, সরকার আমাদের পাশে থাকলে আমরা সফল হব।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে এই মসজিদের ইতিহাস এবং বর্তমান সমস্যা সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন সাবেক সংসদ সদস্য আলহাজ আগাম চৌধুরী। এই মসজিদ নির্মাণ কাজে সকলের প্রতি আন্তরিক সহযোগিতা চান তিনি।
মসজিদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর মহাপরিচালক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আব্দুস সালাম খানের সভাপতিত্বে আরো বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো: নূরী নুরুল্লাহ নূরী, মসজিদ মুসল্লি কমিটির সভাপতি ও একে খান গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আলহাজ্ব সালাউদ্দিন কাশেম খান, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের উপস্থাপনায় ছিলেন মানবাধিকার আইনজীবী এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান।
ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদের পুনঃনির্মাণ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। যার মধ্যে থাকছে, দুইতলা বিশিষ্ট বেইজমেন্ট ফ্লোরে ১৬৫টি গাড়ি পার্কিং সুবিধা, ১৪ হাজার মুসল্লী ও ৫০০ নারী মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা, শিশুদের জন্য কিডস জোন, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ প্রবেশ পথ, মোগল আমলের স্মৃতিসম্বলিত জাদুঘর, ইসলামী রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিস, মাল্টিপারপাস হল, লাইব্রেরী, ফুড কোর্ট এবং গ্রীন কোর্ট, খতিব, ইমাম মুয়াজ্জিন এবং তোমার জন্য আবাসন ব্যবস্থা, সামনে দৃষ্টিনন্দন পানির ফোয়ারা, মসজিদে নববীর মত খোলা জায়গা।
মুলত, চট্টগ্রাম নগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং এটি মুঘল স্থাপত্যশৈলী, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির এক জীবন্ত নিদর্শন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরোনো এই মসজিদটি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে চট্টগ্রামের আকাশরেখায়।
১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিজয়ের পর পরবর্তী বছরই, অর্থাৎ ১৬৬৭ সালে, তৎকালীন মুঘল শাসক শায়েস্তা খাঁর পুত্র উমেদ খাঁ'র তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় এই মসজিদটি। সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে নির্মিত এ মসজিদটি ছিল চট্টগ্রামে মুঘল শাসনের এক অনন্য নিদর্শন। এক সময় এই মসজিদই ছিল চট্টগ্রামের প্রধান জামে মসজিদ। তবে ১৭৬১ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মসজিদটি দখল করে অস্ত্র ও গোলাবারুদের গুদাম হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। বহু বছর মসজিদটিতে নামাজ বন্ধ থাকে। ১৮৫৫ সালে মুসলমানদের আন্দোলনের মুখে মসজিদটি পুনরায় মুসল্লিদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এ আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন হামিদুল্লাহ খাঁ, যিনি চট্টগ্রামের মুসলিম সমাজের কাছে একজন স্মরণীয় নাম।
ঐতিহাসিকভাবে এই মসজিদে ঈদ, জুমা, চাঁদ দেখা ও ফিতরা নির্ধারণসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো। মসজিদের ইমাম ও খতিব হিসেবে ছিলেন আওলাদে রাসূল (সা.)-এর বংশধরেরা, যারা বিশেষ সম্মানিত বলে বিবেচিত হতেন।
আমারবাঙলা/এফএইচ