৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর যশোরের চিত্রামোড়ে অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন সংসদ-সদস্য শাহীন চাকলাদারের মালিকানাধীন জাবির হোটেল ইন্টারন্যাশনালে হামলা ও অগ্নিকাণ্ডে বিদেশিসহ ২৪ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় শাহীন চাকলাদারের চাচাতো ভাই তৌহিদ চাকলাদার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ২০০ জনের নামে মামলা করেন। এক বছরেও মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়নি। এ মামলাকে ভবিষ্যতের মরণফাঁদ হিসাবে দেখছেন জুলাই যোদ্ধারা।
তাদের দাবি, মামলার অজ্ঞাত আসামি কারা, সেটি এখনো শনাক্ত হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে এ মামলা জুলাই যোদ্ধাদের জন্য মরণফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে।
জাবির ট্র্যাজেডির মামলা জুলাই যোদ্ধাদের ‘মরণফাঁদ’: জাবির হোটেল ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এবং ২৪ জন নিহতের ঘটনায় ২০২৪ সালের ১৮ আগস্ট যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু।
অজ্ঞাতনামা ২০০ জনকে আসামি করে এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ৫ আগস্ট আনুমানিক বেলা ৩টায় প্রায় দুইশ অজ্ঞাত সন্ত্রাসী বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে গানপাউডার ও পেট্রোল নিয়ে জাবির হোটেল ইন্টারন্যাশনালের ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমে লুটপাট শুরু করে। সন্ত্রাসীরা হোটেলের ক্যাশ ভোল্ট ভেঙে ৯০ লাখ টাকা লুটসহ একশ পিস ফ্রিজ, ১০০টি স্মার্ট টেলিভিশন, দুটি ৪৫ কেভি জেনারেটর, হোটেল স্টোরের ভেতরে রক্ষিত অনেক মূল্যবান মালামালসহ এক হাজার কেভি ট্রান্সফরমারসহ সব স্টেশন, প্রেশার পাম্প, ফায়ার স্টেশন, ফায়ার ইঞ্জিনসহ আরও মূল্যবান দ্রব্য লুটপাট করে। সন্ত্রাসীরা লুটপাটের পর গানপাউডার ও পেট্রোল দিয়ে হোটেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে একজন ইন্দোনেশিয়ান নাগরিকসহ ২৪ জন মারা যান।
মামলাটির প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম। বর্তমানে এর তদন্তে আছেন কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) বাবুল হোসেন। এই পর্যন্ত এ মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাসহ ৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
১১ জুলাই যশোরে জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় করেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেতারা। এ সময় জুলাই যোদ্ধারা দাবি করেন, জাবির হোটেল ট্র্যাজেডির ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি। শাহীন চাকলাদারের ভাই মামলার বাদী হয়ে ২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করেছেন। মামলাটি ভবিষ্যতে উলটো জুলাই যোদ্ধাদের মরণফাঁদ হিসাবে ব্যবহার হতে পারে। ইতোমধ্যে ওই ঘটনায় নিহতদের নিয়ে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
জুলাই যোদ্ধাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছিলেন, সংস্কারবিহীন সাজানো নির্বাচনের দিকে গেলে আপনাদের কী অবস্থা হবে কল্পনা করুন। আপনাদের সামনে একটা বড় উদাহরণ আছে জাবির ট্র্যাজেডি মামলা। এ ঘটনায় সবাইকে জঙ্গি মামলায় ফাঁসানো হবে। মামলাটির বিষয়ে আমরা কথা বলব। আপনাদেরও কথা বলতে হবে।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর জেলার সাবেক মুখ্য সংগঠক আল মামুন লিখন বলেন, ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আমরা চাঁচড়ামোড় থেকে বিজয় মিছিল বের করেছিলাম। বিজয় মিছিলটি জিলা স্কুলের সামনে পৌঁছানোর পর দেখতে পাই জাবির হোটেল ইন্টারন্যাশনালে আগুনের ধোঁয়া বের হচ্ছে। আনন্দ মিছিলটি হোটেল থেকে প্রায় এক কিমি. দূরে ছিল। তাহলে হোটেলে আগুন দিল কারা? সেই রহস্য এক বছরেও উদ্ঘাটন হয়নি। এক বছরেও সেই ২০০ অজ্ঞাত আসামি শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। ভবিষ্যতে মামলাটি জুলাই যোদ্ধাদের মরণফাঁদে ব্যবহার হওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়। তাই দ্রুত মামলাটি তদন্ত করে আসামি শনাক্ত ও রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি জানাই।
এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) বাবুল হোসেন বলেন, মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন আছে। ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন এবং অজ্ঞাত আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জাবির ট্র্যাজেডিতে নিহতদের ১৩ জনই শিক্ষার্থী : হোটেল জাবিরে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ২৪ জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে পুলিশ। নিহতদের মধ্যে একজন বিদেশি, ১৩ জন ছাত্র, তিনজন ভবঘুরে, তিনজন ব্যবসায়ী, একজন দিনমজুর, একজন আইনজীবী, একজন ড্রাইভার, একজন চাকরিজীবী ছিলেন। তাদের মধ্যে বিএনপি পরিবারের ৯ জন, আওয়ামী লীগ পরিবারের তিন এবং জামায়াত পরিবারের ২ জন রয়েছেন। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না ১০ জন।
নিহত ১৩ শিক্ষার্থী হলেন-যশোর শিক্ষা বোর্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রোকনুজ্জামান রাকিব (২০), যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র সৈয়দ মিঠুন মোর্শেদ পিয়াল (২৫), যশোর জিলা স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র সাকিবুল হাসান মাহি (১৬), যশোর শিক্ষা বোর্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের ছাত্র সামিউর রহমান সাদ (১৭), যশোর সদরে পুলেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মেহেদী হাসান (১৩), ঢাকার গোপীবাগ মাদ্রাসার ছাত্র রুহান ইসলাম (১৮), শংকরপুর হুদা মোমোরিয়াল স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী সাকিবুল হাসান (১৬), যশোর বিএএফ শাহীন কলেজের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আবজাহান মাসনুল নীল (১১), ডা. আবদুর রাজ্জাক মিউনিসিপ্যাল কলেজের এইচএসসি প্রথমবর্ষের ছাত্র আল আমিন (১৮), চৌগাছার পাশাপোল আমজামতলা কলেজের ছাত্র আবুল বাসার (১৯), যশোর সরকারি সিটি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী রিফাত আহমেদ রিয়াদ (১৮), শহরের রেলস্টেশন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র চান (১৪) এবং শহরের পুরাতন কসবা খাদেমুল উলুম ইসলাম মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র খালিদ হাসান শান্ত (১৬)।
বাকিরা হলেন-ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক Diokoutomo, যশোরের বাসিন্দা শিফাত ফেরদৌস (২২), সোহানুর রহমান সিহাব (৩০), হাফিজ উদ্দীন ড্রাইভার (৩৩), তারেক (৩০), আলমগীর হোসেন আলম (২৭), ইউসুফ (১৩), মেহেদী হাসান আলিফ (১৪), অ্যাডভোকেট ফয়সাল আহমেদ আকাশ (২৪), আবু সাঈদ রাসা (২৪) ও ফজল মাহাদী চয়ন (১৮)।
শহীদ স্বীকৃতি নিয়ে বিতর্ক : হোটেল জাবির ট্র্যাজেডির নিহতদের নাম জুলাই শহীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান হওয়ায় চয়ন নামে শিক্ষার্থীকে শহীদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বাকিদের গেজেট প্রকাশ হলেও সেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় নতুন করে চলছে যাচাই-বাছাই। তাদেরই একজন শহরের রেলগেট কলোনিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইউসুফ আলী। তার নাম প্রথম গেজেটে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে ইউসুফের বাবা মানিক হোসেন বলেন, গেজেটে আমার ছেলের নাম আছে। এখন এটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আমার ছেলেকে তো আর পাব না। তবে সরকার যেন ছেলেকে স্বীকৃতি দেয়, সেটাই আমাদের দাবি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের সাবেক আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, যখন আগুন লাগে, তখন মানবিক কারণে আমাদের অনেক ছাত্র-জনতা হোটেলে আটকে পড়াদের উদ্ধারে যান। আটকে পড়াদের আর্তনাদে অনেকেই উদ্ধার করতে গিয়ে মারা যান। ফলে তাদেরে কেন আমরা শহীদ বলব না। এটা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। দ্রুত এসব বিতর্ক সমাধানে আসা উচিত।
জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, সরকার থেকে যখন আহত-নিহতের তালিকা করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাই করে তালিকা প্রস্তুত করি। পরবর্তী সময়ে হোটেল জাবিরের তালিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়; সেই বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে। যদি সরকার মনে করে, তারা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, তদন্তে যদি সেটা প্রমাণ হয়, তাদের নাম বহাল থাকবে। আর যদি প্রমাণিত না হয়, সরকার যা ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেবে, সেটা করা হবে।
আমারবাঙলা/জিজি