চট্টগ্রামের সাগরিকা স্টেডিয়ামসংলগ্ন রেলগেইটে ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল এক সিকিউরিটি গার্ডের। ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে মালবাহী ট্রেন ও চালবোঝাই ট্রাকের সংঘর্ষের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা।
মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) ভোর ৪টা ১৮ মিনিটে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালনরত সিকিউরিটি গার্ড শামসু মিয়া (৫২) নিহত হন। সংঘর্ষের পর ট্রেনের ইঞ্জিনসহ একটি কনটেইনার উল্টে যায় এবং চট্টগ্রাম–ঢাকা রুটে মালবাহী ট্রেন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, চিটাগং গুডস পোর্ট ইয়ার্ড থেকে ভোর ৪টা ১০ মিনিটে ৩১টি কনটেইনারবোঝাই মালবাহী ট্রেনটি কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) উদ্দেশ্যে রওনা হয়। মাত্র আট মিনিট পর ট্রেনটি যখন সাগরিকা স্টেডিয়াম এলাকার রেলক্রসিং অতিক্রম করছিল, তখন বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগতির একটি চালবোঝাই ট্রাক রেললাইন অতিক্রমের চেষ্টা করে। মুহূর্তের মধ্যেই ট্রাকটি ট্রেনের ইঞ্জিনে সজোরে ধাক্কা দেয়।
দুর্ঘটনার সময় শামসু মিয়া রেলগেইটের পাশেই নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। সংঘর্ষে ট্রাকের চালের বস্তাগুলো ছিটকে পড়ে তার ওপর চাপা পড়ে যায়। স্থানীয়রা দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার পর স্থানীয়দের মধ্যে রেলওয়ে গেটম্যানের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ছিল কিনা তা নিয়ে তীব্র প্রশ্ন উঠেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার সময় রেলগেটের ব্যারিয়ার ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়, যা দেখে অনেকেই ধারণা করছেন গেটটি হয়তো সময়মতো নামানো হয়নি। তবে দায়িত্বে থাকা গেটম্যান সিফাত দাবি করেছেন, তিনি নিয়ম মেনে গেট নামিয়ে দিয়েছিলেন। তার ভাষায়, “আমি সিগন্যাল পেয়েই গেট নামিয়ে দিই। ট্রাকটি অতিরিক্ত গতিতে এসে ব্যারিয়ার ভেঙে ঢুকে পড়ে। আমি চিৎকার করে থামানোর চেষ্টা করি, কিন্তু সময় পাইনি।”
অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ওই রেলগেইটে প্রায়ই যানবাহনচালকদের অসতর্কতা দেখা যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, “গেটম্যানরা অনেক সময় গেট নামাতে দেরি করেন, আবার কেউ কেউ সতর্ক সংকেত ঠিকভাবে দেন না।”
রেলওয়ের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ট্রাকচালকের বেপরোয়া গতিই দুর্ঘটনার মূল কারণ। তবে গেটম্যানের দায়িত্বে কোনো গাফিলতি ছিল কিনা, তা তদন্তের পর নিশ্চিত করা হবে। তিনি বলেন, “উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে কাজ করছে। তদন্তে যদি কারও অবহেলা প্রমাণিত হয়, অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার ওসি শহিদুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার কারণে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল কয়েক ঘণ্টা বন্ধ থাকে। সকাল ১০টার দিকে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর আংশিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। তিনি বলেন, “যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলে কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে ট্রাকটি ও উল্টে যাওয়া কনটেইনার সরাতে বেশ সময় লেগেছে।”
ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে এবং চালক পলাতক রয়েছেন বলে জানান ওসি শহিদুল ইসলাম। তিনি আরও বলেন, “চালককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। প্রাথমিকভাবে রেলওয়ে আইনে মামলা প্রস্তুত করা হচ্ছে।”
নিহত শামসু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকার নিরাপত্তা দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তার সহকর্মী ও প্রতিবেশীরা জানান, তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
শামসু মিয়ার সহকর্মী আজিজুল হক বলেন, “প্রতিদিন ভোরে তিনি দায়িত্বে চলে আসতেন। এমন একজন মানুষকে আমরা হারালাম, এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।” নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, শামসু মিয়ার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম নগরের সাগরিকা, পাহাড়তলী ও জাকির হোসেন রোডের রেলক্রসিংগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি বহুদিন ধরেই রয়েছে। অনেক গেটেই স্বয়ংক্রিয় ব্যারিয়ার বা আলোক সংকেত নেই। ফলে এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
রেলপথ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নুরুল আমিন বলেন, “রেলক্রসিং এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জরুরি। শুধুমাত্র মানবগেটম্যানের ওপর নির্ভর করলে দুর্ঘটনা রোধ করা কঠিন।”
সাগরিকা রেলগেইটের এই দুর্ঘটনা আবারও স্মরণ করিয়ে দিল—রেলক্রসিং নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা কতটা প্রাণঘাতী হতে পারে। এক মুহূর্তের অসতর্কতায় ঝরে গেল এক নিরপরাধ মানুষের প্রাণ। তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় যে কারও অবহেলায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত ন্যায়বিচার।
আমারবাঙলা/এফএইচ