কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন— ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, আজ বসন্ত।’ শীতের রুক্ষতা-স্তব্ধতা ভেঙে এসেছে বসন্ত। ফুলও ফুটেছে, পাখিও গাইছে।
আজ পহেলা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। শিমুল পলাশের রঙিন আবহে সুন্দরের প্রাচুর্য নিয়ে প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। দখিন হাওয়ার গুঞ্জরণ এই মাত্রা বাড়িয়ে দেয় আরো কয়েক গুণ। বাসন্তী রঙের নানা ফুল প্রকৃতি রাঙিয়ে মাতাল হাওয়ায় দোল খেয়ে যায় সবার মনে মনে।
আজ ‘হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে’ও। বসন্ত ও ভালোবাসা মিলেমিশে আজ শুধুই ভালোবাসার দিন। নতুনের কলরব চারিদিকে। প্রকৃতি পূর্ণ আজ অবারিত আনন্দে। কেবল প্রকৃতিতেই নয় মানুষের হৃদয়েও নতুনের ছোঁয়া।
বসন্তকে স্বাগত জানাতে নানা উদ্যোগ, নানা আয়োজন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। গ্রামীণ মেলা, সার্কাস ও অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠানে বরণ করে নেওয়া হবে বসন্তকে।
তবে একইসঙ্গে আজ পবিত্র শবে বরাত (মুসলিমদের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান) হওয়ায় বসন্ত ও ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপনের মাত্রায় ভিন্নতা আসবে বলে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশে বসন্ত ঋতুটি ‘ঋতুরাজ বসন্ত’ নামে পরিচিত। এর অর্থ সকল ঋতুর রাজা। এটি বাংলা মাস ফাল্গুন ও চৈত্র নিয়ে গঠিত। বাংলা ক্যালেন্ডারের শেষ ঋতু বসন্ত।
‘ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল/ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল/চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়/বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়/স্পন্দিত নদীজল ঝিলিমিলি করে/জ্যোৎস্নার ঝিকিমিকি বালুকার চরে/নৌকা ডাঙায় বাঁধা, কান্ডারি জাগে/পূর্ণিমারাত্রির মত্ততা লাগে।/খেয়াঘাটে ওঠে গান অশ্বত্থতলে/পান্থ বাজায়ে বাঁশি আনমনে চলে।/ধায় সে বংশীরব বহুদূর গাঁয়/জনহীন প্রান্তর পার হয়ে যায়।/দূরে কোন শয্যায় একা কোন? ছেলে/বংশীর ধ্বনি শুনে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত ‘ফাল্গুন’ কবিতা এটি।
১৪৩১ বঙ্গাব্দের শেষ ঋতু বসন্তের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুনের মানসপটে বার বার হানা দিচ্ছে কবিগুরুর এ ‘ফাল্গুন’। ঋতুরাজ বসন্ত আবাহনের ক্ষণযাত্রা। ফুলেল মধুময় ও যৌবনের উদ্যমতা বয়ে আনার বসন্ত, উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতায় মন-প্রাণ কেড়ে নেওয়ার বসন্ত।
স্বাগত বসন্ত। প্রাণ খুলে তাই যেন কবির ভাষায় বলা যায়, ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গায়...।’ রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের আকুতি যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে— ‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/আমার আপনহারা প্রাণ/আমার বাঁধন ছেঁড়া প্রাণ/তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান/তোমার অশোকে কিংশুকে/অলক্ষ্যে রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে...।’
কোকিলের কুহুতান, দখিনা হাওয়া, ঝরাপাতার শুকনো নূপুরের নিক্বণ, প্রকৃতির মিলন এ বসন্তেই। বসন্ত মানেই যে পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। বসন্ত মানেই একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। মিলনের এ ঋতু বাসন্তী রঙে সাজায় মনকে, মানুষকে করে আনমনা।
শীতের জীর্ণতা সরিয়ে ফুলে ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। গাছে গাছে নতুন পাতা, স্নিগ্ধ সবুজ কচি পাতার ধীর গতিময় বাতাস জানান দেয় নতুন লগ্নের। ফাল্গুনের আগমনে পলাশ, শিমুল গাছে লেগেছে আগুনে খেলা। মধুর বসন্তের সাজ সাজ রব সর্বত্র। পুরো প্রকৃতিতে চলছে— ‘মনেতে ফাগুন এলো’ আবহ।
এমন ফাল্গুনেই, বায়ান্নর আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশরাঙা দিনে তারুণ্যের ‘শব্দ বিপ্লব’, ‘সাহসী উচ্ছ্বাস’ ও বাঁধভাঙা আবেগে বাংলা একাকার হয়েছিল।
ঋতুচক্র এখন পঞ্জিকার অনুশাসন মানতে নারাজ! কুয়াশার চাদরে মোড়া শীত জেঁকে বসতে না বসতেই বিদায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুচক্রেও এসেছে নতুন ব্যঞ্জনা। সময়মতো শীত আসে না, বর্ষাও তা-ই। গ্রীষ্মের খরতাপও মানে না নিয়ম। এসবের মাঝেও অনেকটা স্বমহিমায় দীপ্যমান বসন্ত। প্রকৃতির এ আনন্দবার্তায় নাগরিক মনও তাই উচ্ছ্বসিত।
বাঙালির জীবনে বসন্তের উপস্থিতি অনাদিকাল থেকেই। কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায় আছে বসন্তের বন্দনা। সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে নানা অনুপ্রাস, উপমা ও উৎপ্রেক্ষায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক বাউল কবির মনকেও বার বার দুলিয়েছে, দোলাচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত।
গ্রামের মেঠোপথ, নদীর পাড়, গাছ, মাঠভরা ফসলের ক্ষেত বসন্তের রঙে রঙিন। চোখ বুজলেও টের পাওয়া যায় এমন দৃশ্যপট। নাগরিক ইট-কাঠ-পাথরের জীবনে বসন্ত এসেছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও অমর একুশে বইমেলা নিয়ে। এমন দিনে রমণীরা বাসন্তী রঙে রাঙিয়ে তুলবে রাজপথ, পার্ক, বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশোভিত সবুজ চত্বরসহ পুরো নগরী। কংক্রিটের নগরীতে কোকিলের কুহুস্বর ধ্বনিত হবে ফাগুনের আগমনে। একই দিন ‘হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে’ হওয়ায় নগরী পাবে অন্যরকম আবহ।
যানজট, কোলাহল ছাপিয়ে যেটুকু প্রকৃতি নগরে মেলে, এতেই গদগদ নগরের নাগরিকরা! যতই নিষ্প্রাণ, হিসাবি, প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন হন না কেন, বসন্তের এ দিনে তারা গেয়ে উঠবেন ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে/ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে...।’ যেন তাদের ‘হারিয়ে যেতে আজ নেই মানা।’
‘বাসন্তী তরুণী’রা খোঁপায় গাঁদা, পলাশসহ নানা ফুল গুঁজে আর ‘বসন্ত তরুণ’রা পাঞ্জাবি ও ফতুয়ায় নতুন করে নিজেদের সাজিয়ে নেমে আসবেন পথে পথে। মোবাইল ফোনে এসএমএস আদান-প্রদান, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, টুইটার প্রভৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে বরণ করা হবে ঋতুরাজ বসন্তকে।
বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। ‘ছায়ানট’ বসন্ত উৎসব শুরু করে ১৯৬২ সালে। দিনে দিনে তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।
গ্রামেও এখন ফাগুনের ছোঁয়া। গাঁয়ের বধূরা আজ আঙিনা লেপে বরণ করে নেবে ফাগুনকে। তুলে রাখা হলদে শাড়িও বের করবে আজ। শুরু হবে বোরো চারা রোপণের পালা। মাঘের শীতে আবাদের মাঠে যেতে পারেননি কৃষক। ফাগুনের দিনে তারা স্বাচ্ছন্দ্যেই যেতে পারবেন। বসন্ত সবার হৃদয়ে এনে দেয় ফাগুনের দোলা।
সরগরম ফুলের বাজার : বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে সরগরম হয়ে উঠেছে ফুলের বাজার। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানী, গুলমাণ ধানমন্ডি, শাহবাগসহ বিভিন্ন ফুলের দোকানে ক্রেতাদের আগমনে জমে উঠে বেচাকেনা।
এবারের বসন্ত ও হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় সব ধরনের ফুলের দাম কয়েকগুণ বেশি। দাম বেশি হলেও বসন্ত বরণের উৎসব এবং ভালোবাসার কাছে যে বাড়তি দাম কোনো বিষয়ই নয়, তারই প্রমাণ মেলে এ ভিড়ে।
রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে ফুলের দামের ভিন্নতাও দেখা গেছে। রাজধানীর একাধিক ফুলের দোকানদার জানান, ফুলের চাহিদা যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। ফুলের বেচাকেনাও জমে উঠেছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেচাকেনা আরো বাড়বে।
সদ্য বিবাহিত কামরুল হাসান সবুজ সস্ত্রীক শাহবাগে এসেছেন ফুল কিনতে। এ নবদম্পতি জানান, বসন্ত উৎসব, ভ্যালেন্টাইন ডে এবং শুক্রবার বইমেলা উপলক্ষে প্রচণ্ড ভিড় হবে, তাই একদিন আগেই ফুল কিনতে এসেছি। ফুলের দাম প্রসঙ্গে তারা বলেন, ভালোবাসা দিবসে ফুলের দাম প্রতিবছর বেশিই থাকে। বেশি দাম দিয়েই কিনতে হলো। কিছুই করার নেই উৎসব তো পালন করতেই হবে।
শাহবাগ ফুল বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আবুল কালাম কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এবারের চিত্র ভিন্ন। নানা কারণে মানুষ শাহবাগ মোড় অবরোধ করছে। এ অবস্থায় রাস্তা বন্ধ থাকলে কেউ ফুল কিনতে আসবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মারিয়া নূর উৎসবের তাৎপর্য নিয়ে আবেগঘন মন্তব্যে বলেন, বসন্ত উৎসব বাঙালির জন্য একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব। ফুটে ওঠা ফুল, নতুন পাতা, প্রকৃতির মৃদু মন্দ বাতাস সবই বসন্তের সৌন্দর্যের স্মারক।
পহেলা ফাল্গুন উদযাপনে অংশ নেবেন তিনি। তাই আগ্রহ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, চারুকলার আয়োজন নিয়ে আমি উচ্ছ্বসিত। পহেলা ফাল্গুন বাংলাদেশের মানুষের জন্য যেভাবে আনন্দ বয়ে আনে তা আমার খুবই ভালো লাগে।
বসন্ত প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং বাঙালি চেতনার মধ্যকার চিরন্তন সংযোগে এক উল্লেখযোগ্য আবেদন তৈরি করে। আশা, সৌন্দর্য এবং নবজাগরণের এ ঋতুকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত সকলেই।
কর্মসূচি : বসন্তের প্রথম দিনকে স্বাগত জানাতে নানা উদ্যোগ, নানা আয়োজন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদ, উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরে মুক্তমঞ্চ, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কসহ রাজধানীতে একাধিক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়েছে জাতীয় বসন্ত উৎসব আয়োজক কমিটি।
কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বলেন, চলতি বছর পহেলা ফাল্গুন এবং পবিত্র শবে বরাত একইসঙ্গে হওয়ায় উৎসবটি অর্ধদিবস পালিত হবে।
সুইট বলেন, আমরা ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা বাদ দিয়ে সকাল ৭টা থেকে দুপুর পর্যন্ত উৎসব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাজধানীর তিনটি স্থানে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি পালিত হবে।
এদিকে চারুকলার বকুলতলায় (চারুকলা অনুষদ) অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। বকুলতলায় ফাল্গুনকে বরণে বর্ণাঢ্য আয়োজন থাকছে।
চারুকলার আয়োজনে থাকবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বসন্তের গান, কবিতা আবৃত্তি, লোকগান এবং নৃত্য। এ আয়োজনে মোট ৪২টি সাংস্কৃতিক দল অংশ নেবে। রাজধানীর অন্য দুটি ভেন্যুতেও একই ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            