সংগৃহিত
মতামত

ব্যাটারিচালিত রিকশা : প্রয়োজন শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ

রেজোয়ান হক: আলোচিত ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে বড় দুটি অভিযোগের একটি হলো ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হয় অবৈধ বিদ্যুৎ লাইনে বা চোরা লাইনে, যা বিদ্যুৎ সংকট বাড়াচ্ছে। কিন্তু স্বয়ং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২০২৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে বক্তৃতায় দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই রিকশাকে ‘বাংলার টেসলা’ নাম দিয়ে বলেন এই যানবাহন সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব, রাষ্ট্রীয়ভাবে এই বাহনকে উৎসাহিত করা হবে। টেসলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ জনপ্রিয় ব্যাটারিচালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি।

১৫ মে ২০২৪ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ‘ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ’ করার সিদ্ধান্ত দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পুলিশ অভিযান শুরু করে।

১৯ মে ২০২৪ ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকেরা টানা দুইদিন আন্দোলন করে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ধরে টান দিলে সেই ওবায়দুল কাদেরই ২০ মে ২০২৪ জানান, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে।

সিদ্ধান্ত ঘোষণা, আন্দোলন এবং সিদ্ধান্ত বাতিল—মাত্র পাঁচদিনের মধ্যে ঘটলো। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য যোগ করলে দেখা যায় এই ইস্যুতে মন্ত্রীদের কথাবার্তা, সরকারের অবস্থানের মধ্যে কোনো মিল নেই। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতাসীন অভিজ্ঞ একটি সরকারের জন্য এটা খুবই বেমানান।

আন্দোলনকারী রিকশা চালকেরা নিতান্তই সাধারণ মানুষ, তাদের বড় কোনো নেতা নেই, বিদেশি উসকানিদাতা নেই, তারপরও মাত্র দুইদিনের আন্দোলনে সরকার তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে। এত দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণ—সরকার বুঝতে পেরেছে সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল।

এক্ষেত্রে ভুল আসলে আগে থেকেই হয়ে আসছে। বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের আনুমানিক হিসাব বলছে, ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা সাত লাখের বেশি। রাজধানীতে চলছে প্রায় ৮০ হাজার। দেশজুড়ে প্রায় ৩০ ধরনের ব্যাটারিচালিত অনুমোদনহীন যানবাহন চলছে। আর যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সারা দেশে ইজিবাইক ও ব্যটারিচালিত যানবাহনের সংখ্যা কমপক্ষে ৪০ লাখ।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর জানাচ্ছে, নীতিমালা না থাকায় এই বাহনটি ঘিরে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য চলছে। রিকশা রাস্তায় নামাতে হলে টাকার বিনিময়ে টোকেন নিতে হয়। তাতেও নির্বিঘ্নে চলাচলের নিশ্চয়তা নেই। নানা অজুহাতে পুলিশি অভিযান থেকে বাঁচতে নিয়মিত টাকা দিতে হয়। রাজধানীতে ব্যাটারি রিকশার এই মধুচক্রে পুলিশ ছাড়াও স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা ও পাড়া-মহল্লার মাস্তানরা জড়িত।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য যোগ করলে দেখা যায় এই ইস্যুতে মন্ত্রীদের কথাবার্তা, সরকারের অবস্থানের মধ্যে কোনো মিল নেই। টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতাসীন অভিজ্ঞ একটি সরকারের জন্য এটা খুবই বেমানান।

এটাও সত্যি, এসব রিকশার চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, বাইকারদের একাংশের কারণে মোটরসাইকেলও যে দোষে দুষ্ট। কিন্তু এটাও ঠিক-চলাচল বন্ধ করে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না, বেকারত্ব বাড়ানোসহ সামাজিক নানা সমস্যা বরং বাড়বে।

দীর্ঘদিন গণপরিবহনে চলাচলের অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে, বিশৃঙ্খলাই এই খাতের মূল সমস্যা। কোনো সরকারই যা দূর করতে চায়নি বা পারেনি, বিপুল ক্ষমতাধর বর্তমান সরকারও নয়, বরং পরিবহন খাতের পান্ডারা কিছুটা প্রশ্রয়ই পেয়ে আসছে।

সড়ক পরিবহন আইন তার একটি উদাহরণ। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আইনটি পাস হয়। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার কারণে আইনটি কার্যকর হয় এক বছরেরও বেশি সময় পর। বিধিমালা জারি হয় আরও ৩ বছর পর ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে।

আর মূলত পরিবহন শ্রমিকদের দাবির মুখে ২০২৪ সালের মার্চে আইনের অন্তত ১২টি ধারায় পরিবর্তন এনে চালক ও হেলপারদের জেল জরিমানা ও শাস্তি কমিয়ে আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের অবাস্তব এবং অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের সর্বশেষ উদাহরণ ৮ মে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-র ‘মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা ২০২৪’ জারি। একদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশের সড়কে বেশি গতির ৩৫০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দিয়েছে, অন্যদিকে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিআরটিএ গতিসীমা বেঁধে দিয়েছে। তার মধ্যেও চিন্তাভাবনার কোনো ছাপ নেই।

এই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, মহানগরে গাড়ি চলবে সর্বোচ্চ ৪০ এবং বেবি ট্যাক্সি ও মোটরসাইকেল ৩০ কিলোমিটার গতিতে। কিন্তু কম বা বেশি গতির যানবাহনের জন্য লেন নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে কিন্তু যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকায় মানুষ ঠিকমতো এর সুফল পাচ্ছে না।

ফিরে আসি ব্যাটারিচালিত রিকশা ইস্যুতে। রাস্তায় নানা ডিজাইনের ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে দেখা যায় যেগুলোর সবগুলোই যান্ত্রিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ। এটা এই কারণে হয়েছে যে, এগুলো বানাতে কারও কোনো অনুমোদন দরকার হয়নি।

দেশে এখন এই ধরনের রিকশার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। ঢাকার বাইরে সাধারণ মানুষের চলাচলের প্রধান বাহন হয়ে উঠেছে এগুলো, বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে। তাই এগুলো রি-ডিজাইন করে একটি মডেলে নিয়ে আসা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া যায়।

দীর্ঘদিন গণপরিবহনে চলাচলের অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে, বিশৃঙ্খলাই এই খাতের মূল সমস্যা। কোনো সরকারই যা দূর করতে চায়নি বা পারেনি, বিপুল ক্ষমতাধর বর্তমান সরকারও নয়

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সেইদিন সংসদে আরও জানিয়েছিলেন, এসব রিকশা লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি ব্যবহার করে যা চার্জ করতে সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগে, এগুলো যদি লিথিয়াম ব্যাটারি হয় তাহলে সময় লাগবে মাত্র আধা ঘণ্টা, বিদ্যুতের ব্যবহারও অনেক কমবে।

লেড ব্যাটারি নিয়ে তাদের লিথিয়াম ব্যাটারি দেওয়ার প্রকল্পও হাতে নিয়েছেন তারা। তিনি আরও বলেন, সারা বিশ্বে এখন বৈদ্যুতিক গাড়ির বিপ্লব চলছে। তেলচালিত গাড়ির ইঞ্জিনের দক্ষতার মাত্রা হলো ২০ শতাংশ, অন্যদিকে ইলেকট্রিক যন্ত্রের দক্ষতা ৮০ শতাংশ।

বাজারে যত দ্রুত সম্ভব ইলেকট্রিক গাড়ি আনতে আমরা উৎসাহ দিচ্ছি। দেশের রাস্তায় যত গণপরিবহন চলে সেইগুলো দ্রুততার সঙ্গে বৈদ্যুতিক করা উচিত। এগুলো পরিবেশবান্ধব এবং খরচও কম।

আমি বিশেষজ্ঞ নই, তাই এর সত্যতা সম্পর্কেও নিশ্চিত নই। তবে একটা কথা মনে পড়ছে, আমদানি নির্ভর জ্বালানি তেলের ওপর চাপ কমাতে একসময় সব যানবাহনকে গ্যাসে চালানোর উপযোগী করে কনভার্ট করতে উৎসাহ, ক্ষেত্র বিশেষে চাপও দেওয়া হয়েছিল।

বেশিরভাগ গাড়ি সেইভাবে কনভার্ট করাও হয়। কিন্তু দেশে গ্যাস সংকট দেখা দেওয়ার পর থেকে দিনের বড় সময় পাম্পে গ্যাস দেওয়া বন্ধ থাকে, বাকি সময়টাতেও প্রেশার কম থাকার অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। তাই গ্যাস নিতে পাম্পে গাড়ির লাইন লেগেই থাকে, সময়ও নষ্ট হয়।

দেশে তো বিদ্যুতেরও সংকট দেখা দিয়েছে। গাড়িগুলো বিদ্যুতে চলা শুরু করলে কী হয় কে জানে। সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া উচিত ভেবেচিন্তে, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে। তা করা হলে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে আন্দোলনের দুইদিনের মাথায় সরকারকে পিছু হটতে হতো না।

আবার দেখেন, চালুর অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মেট্রোরেলের ভাড়া, যা বেশি বলে আগে থেকেই সমালোচনা রয়েছে, তার ওপর ভ্যাট বসাতে চায় রাজস্ব বোর্ড, ফলে ভাড়া আরও বাড়বে। এতে অসন্তুষ্ট সড়ক মন্ত্রী, এটা যাতে না করা হয় সেইজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়েছেন।

রাজস্ব বোর্ড কি সরকারের বাইরের কেউ? তারা কি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে এভাবে ভ্যাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে? কী একটা অবস্থা। সব জায়াগায় সমন্বয়হীনতা। প্রশ্ন হলো, তাদের সমন্বয়হীনতার জন্য জনগণ কেন ভোগান্তিতে পড়বে?

লেখক: কলামিস্ট

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

রাজধানীতে ৩ বাসে অগ্নিসংযোগ, হাতবোমা বিস্ফোরণ

রাজধানীর হাজারীবাগ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও সাভারে তিনটি বাসে অগ্নিসংযোগ এবং ঢাকা...

বিষমিশ্রিত দানায় ৩৩৫ হাঁসের মৃত্যু, খামারির মাথায় হাত

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় বিষমিশ্রিত ধান খেয়ে এক খামারির ৩৩৫টি হাঁস মারা গেছে...

মৌলভীবাজার পৌর বিএনপির দায়িত্বে কামাল

মৌলভীবাজার পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার আহমেদ দেশের বাইরে থাকায় তাঁর অনু...

গাজীপুরে গভীর রাতে গ্রামীণ ব্যাংকে পেট্রলবোমা হামলা

গাজীপুরের শ্রীপুরে গভীর রাতে মাওনা ইউনিয়নের বারতোবা বাজারে গ্রামীণ ব্যাংকের...

তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হলে নদীভাঙন কবলিত নোয়াখালী হবে সিঙ্গাপুর: ফখরুল ইসলাম

নোয়াখালী-৫ (কোম্পানীগঞ্জ–কবিরহাট) আসনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী জেলা...

শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ, শেখ হাসিনার আ. লীগ মানেই বাংলাদেশ

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্র...

ইরান আর ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে না

গত জুনে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতের পর থেকে নিজেদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ...

‘বিচার স্বচ্ছ হয়েছে, শেখ হাসিনা খালাস পেলে খুশি হতাম’

সোমবার (১৭ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্টাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের প্রশ...

৪ যুগ ধরে স্বপ্নের সেতুর অপেক্ষায় হাজারো মানুষ

শুধু মাত্র ৬০ ফুটের একটি সেতুর অভাবে নিত্য দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁশের সাঁকো...

উলিপুরে মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন

কুড়িগ্রামের উলিপুরে প্রতারণার অভিযোগে চিহিৃত মানব পাচারকারী মমিনুল ইসলাম বাবল...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা