ছবি: তারিকুর রহমান রিপন
মতামত

কোন পথে আমাদের গণতন্ত্র

তারিকুর রহমান রিপন

আবুল ফজল আল্লামী তাঁর আইন ই আকবরী গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন—“এখনকার মানুষ আসন চিনে না, ব্যক্তি চিনে।” বহু আগের এই মন্তব্য আজও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। আসনের মর্যাদা অগ্রাহ্য করার কারণেই ব্যক্তির প্রতি ঝোঁক আমাদের সমাজে এত প্রবল।

মূল কথায় আসি—বাঙালি জাতি স্বভাবগতভাবে বিদ্রোহী। বাঙালির হৃদয়ে দ্রোহের আগুন সব সময়ই জ্বলতে থাকে, যদিও তা সব সময় বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তবে জাতি হিসেবে আমরা যে খুব শান্ত—তাও বলা যায় না।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশে বহুবার আন্দোলন, বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপ এখনো আমরা দেখতে পাইনি। বৃটিশ আমল থেকেই ফকির বিদ্রোহ, তিতুমিরের আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, ’৫২–এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯–এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১–এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০–এর আন্দোলন, ’৯৬–এর তত্ত্বাবধায়ক দাবির আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ ’২৪–এর গণঅভ্যুত্থান—সবই তার উদাহরণ।

১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পূর্ণ মূল্যায়ন ছাড়াই আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাই। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। গণতন্ত্রের প্রকৃত সংজ্ঞা—এটিও আমরা কখনো গভীরভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করিনি।

সব সরকারের আমলেই ক্ষমতা ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। দলে ব্যক্তি বন্দনা এবং কাউকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বানানোর প্রবণতা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা সৃষ্টি করেছে। ক্ষমতালিপ্সার কারণে হাজার বছরের গণতন্ত্রের স্বপ্ন আজ রাষ্ট্রের চেয়ে দল, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠেছে। ফলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণতন্ত্রের চর্চা কখনোই দৃশ্যমান ছিল না।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের একটি নৈতিক ভিত্তি ছিল—তার ফল আমরা পূর্ণভাবে পেয়েছি। তেমনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেরও ছিল স্পষ্ট নৈতিক স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন আমাদের শক্তি হয়ে এসেছিল এবং সেই শক্তি ব্যবহার করে আমরা স্বাধীনতাও অর্জন করেছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই নৈতিক স্বপ্ন এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাই বলেছিলেন—“আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক স্বপ্ন আজও অর্জিত হয়নি।”

স্বাধীনতার আগে পশ্চিমা শাসকদের জুলুম, নির্যাতন ও গণতন্ত্রহীনতার গল্প নতুন করে টানলাম না। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও দেশে অব্যাহত অরাজকতা ও দুর্নীতি দেখে যারা দেশ নিয়ে ভাবেন—তাদের দুঃখ ও ক্ষোভ স্বাভাবিক।

আজ এমন মানুষ দেখা কঠিন—যিনি দুর্নীতি ও অন্যায়ের চাপে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না। সত্যি বলতে—বাঙালির নৈতিকতার সুনাম কোন দিনই খুব উজ্জ্বল ছিল না। প্রতিদিনের জীবনে অনৈতিকতার অসংখ্য উদাহরণ আমরা দেখি। যে দেশে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নৈতিক মান প্রশ্নবিদ্ধ—সে দেশে গণতন্ত্র স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কঠিন।

গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়ার আরেকটি কারণ—রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন না; তারা বর্তমান নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। অতীত থেকে শিক্ষা না নেওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণেই এ দেশে বারবার আন্দোলন ও অভ্যুত্থান ঘটেছে। প্রতিটি আন্দোলনই বড় ধরনের সংস্কারের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, কিন্তু রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং ক্ষমতার অসম প্রতিযোগিতার কারণে তা টিকে থাকেনি।

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আলোচিত বিষয়—সংবিধান। প্রতিটি দলই নিজস্ব ফর্মুলা দিচ্ছে। কেউ সংবিধান সংশোধনের কথা বলছে, কেউ আবার সংবিধান বাতিল করে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি তুলছে। কিন্তু এগুলোতে জনমতের প্রতিফলন ঘটছে কি না—এটাই বড় প্রশ্ন। কারণ, জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতা; আইন বা সংবিধান নয়। আর সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রক্ষাকবচ।

আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে—তা নিয়ে মতভেদ বিশাল। এত মতভিন্নতার কারণে গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসছে না। ফলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে গণতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ় করার সুযোগ বারবার নষ্ট হচ্ছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হচ্ছে না। অথচ মনে রাখতে হবে—জনগণ নীরব হলেও তারা দুর্বল নয়। ইতিহাস বলে—পুলিশ, সামরিক বাহিনীসহ রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তির চেয়েও বড় শক্তি হলো জনগণ। অস্ত্র দিয়ে কখনো জনগণের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না।

এখন প্রশ্ন—অতীত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান বাস্তবতার আলোকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র কি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে, নাকি আমরা একই চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকব?

—— সাংবাদিক ও লেখক।
E-mail: [email protected]

● আমারবাঙলা/এফএইচ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

২০২৬ সালের এইচএসসি ফরম পূরণের সময়সূচি ঘোষণা করল ঢাকা শিক্ষা বোর্ড

২০২৬ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফরম পূরণের তারিখ জানিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও...

ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে নারায়ণগঞ্জ, জনমনে বাড়ছে আতঙ্ক

চলতি মাসের ২১ তারিখে হওয়া আকস্মিক ভূমিকম্পের পর নারায়ণগঞ্জজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ কর...

নোয়াখালীতে ৫ চোরাই মোটরসাইকেল উদ্ধার, বিএনপি নেতার ভাইসহ গ্রেপ্তার ৪

নোয়াখালীর কবিরহাটে পৃথক পৃথক অভিযানে আন্তঃজেলা মোটরসাইকেল চোরচক্রের ৪ সদস্যকে...

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর এখন ঢাকা

জাতিসংঘের এক নতুন প্রতিবেদন অনুসারে, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা এখন বিশ্ব...

বাংলাদেশ নৌবাহিনী লেবাননে ইউনিফিল মিশনে

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন ইউনিফিল-এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে বাংলাদেশ...

সিসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে খালেদা জিয়া

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়...

নকলে ধরা খেয়ে বিদ্যালয়ের শৌচাগারে স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা

নোয়াখালীর সদর উপজেলায় বার্ষিক পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সময় ধরা খেয়ে এক ছাত্...

কোন পথে আমাদের গণতন্ত্র

আবুল ফজল আল্লামী তাঁর আইন ই আকবরী গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন—“এখনকার...

ফেনীর সোনাগাজীতে বন্যাদুর্গতদের মাঝে গবাদিপশু ও শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের বন্যাদুর্গত পরিবারগুলোর মাঝে গবাদিপশু...

সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের ১৮ বছরের কারাদণ্ড

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্লট বরাদ্দে দু...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা