সংগৃহীত
ঐতিহ্য ও কৃষ্টি

স্মৃতিময় ‘ধলগাঁ হাট’ ২০০ বছরের পুরোনো

যশোর প্রতিনিধি

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার ধলগ্রামে কাজলা নদীতীরে ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসে একটি হাট। এটি ধলগ্রাম হাট নামে পরিচিত। তবে বলা কথা বিকৃত হয়ে এখন ‘ধলগাঁ হাট’ নামেই সবাই বেশি চেনে। সপ্তাহের দুদিন— শনি ও বুধবার বসে এই হাট। প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে এই হাটের সঙ্গে।

ভোরে হাট বসে, ভাঙে রাতে। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে নিয়মিত বাজার বসে। বাঘারপাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে থেকেও লোকজন বাজার করতে এখানে আসেন।

যশোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে ধলগ্রাম হাটের অবস্থান। নদীর তীরে বিশাল এক বটগাছ। এর সঙ্গে জড়াজড়ি করে বেড়ে উঠছে পাকুড়গাছ। এই গাছে নিচে বসে হাটটি। তবে আশপাশের প্রায় ১০ একর জায়গাজুড়ে হাটের বিস্তৃতি।

সরেজমিন দেখা যায়, এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে চিত্রা। পশ্চিম থেকে পূর্বমুখী নদীটি আচমকা বাঁক নিয়ে দক্ষিণমুখী হয়েছে। নদীটি যেখানে বাঁক নিয়েছে সেই জায়গার নাম ধলগ্রাম। বাঁক থেকে একটি নদী বেরিয়ে সোজা পূর্ব দিকে চলে গেছে। নদীর নাম কাজলা। বাঁক নেওয়ার জায়গার থেকে কিছুটা দূরে নদীর তীরে ধলগ্রাম হাট।

গত বুধবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, হাটের ভেতর গলি। ইটের তৈরি গলির দুই পাশে সারি সারি ছোট-বড় টিনের দোকানঘর। কোনোটি দোকানঘরের টিন জরাজীর্ণ, কোনোটির টিন মাটিতে নুইয়ে পড়ে আছে। দোকানঘরের বারান্দায় এবং দোকানঘরের সামনে ত্রিপল টানিয়ে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে অস্থায়ী দোকান। সেখানে চলছে বেচাকেনা। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দেখছেন। কেউ কেউ দোকানির সঙ্গে দর-কষাকষি করছেন। বনিবনা না হলে অন্য দোকানে গিয়ে একই পণ্যের দাম যাচাই করছেন।

হাটে এসেছেন অশীতিপর মোসলেম মুন্সী। তার বাড়ি দশপাখিয়া গ্রামে। তিনি ভালো দেখেন না। তবে শ্রবণশক্তি প্রবল। এই বয়সেও তিনি এসেছেন হাটে। তিনি হাট থেকে পান ও তামাক কিনবেন।

বাবা মিরাজ খাঁর সঙ্গে বালকবেলা থেকেই তিনি আসেন এই হাটে। তিনি বলেন, ‘খুব ছোটকাল থেকে দেখেছি এখানকার হাটে বাইরের জেলার লোক আসতো পাট, ধান আর গুড় কিনতে। ঘাটে দেখতাম শয়ে শয়ে নৌকা বাঁধা। সেই সময় অবশ্য এতো দোকানঘর ছিল না।’

হাটে এসেছেন আন্দুলবাড়িয়া গ্রামের পুলিন বিশ্বাস (৭৫)। তিনি সবজি আর মাছ কিনবেন। তিনি বলেন, বাবা-ঠাকুরদারাও এই বাজারে আসতেন। অনেক বছর ধরে এখানে হাট চলে আসছে।

হাটে দেখা হয় আন্দুলবাড়িয়া গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলামের (৭২) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আব্বার ছিকেবাঁকের ডালায় বসে হাটে আসতাম। ধান বিক্রি করে আব্বা বাজার-সদাই করতেন। আর আমাকে কিনে দিতেন পদ্মপাতায় করে রসগোল্লা, জিলাপি, বাতাসা বা দানাদারের মতো মিষ্টি। কখনো কখনো সেই সময়কার বিখ্যাত নিমতলার ভাজা শালপাতায় করে কিনে দিতেন।’

শহিদুল ইসলাম আরো বলেন, বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি এই হাটে অনেক দূর থেকে লোকজন আসতেন। তারা মূলত এখানকার পাট ও ধান কেনার জন্যে বড় বড় নৌকা নিয়ে ঘাটে আসতেন। এক-দুই দিন থাকতেন। ধান ও পাট কিনে নৌকাবোঝাই দিয়ে আবার ফিরে যেতেন।

৫০ বছর ধরে হাটে ত্রিপল টানিয়ে তেল, লবণ, মশলা বিক্রি করেন বল্যামুখ গ্রামের চম্পক কুমার কুণ্ডু (৬৭)। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহের দুই দিন নিয়মিত হাট করি। সকাল থেকে হাট শুরু হলেও দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকজন হাট করতে আসেন। গরম মসলা, জিরা, হলুদ, ডাল, লবণ, ঘানিভাঙা শর্ষের তেল, সয়াবিন তেল, শুকনা মরিচ ইত্যাদি বিক্রি করি। প্রতি হাটে কমপক্ষে ১০ কেজি শর্ষের তেল এবং ২০ কেজি সয়াবিন তেল বিক্রি হয়।’

ধলগ্রাম হাটের প্রধান অংশে রয়েছে নদীর তীরে একটি ঘাট। এই ঘাটে ভেড়ে নৌকা, ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। হাটে আসা লোকজন ব্যবহার করেন বহু পুরনো এই ঘাট। নদীর ঘাট থেকে ওপরে উঠেই একটি গলি। কংক্রিটের ঢালাই দেওয়া গলির দুই পাশে সারি সারি আড়ত।

আড়তদার অরুণ কুন্ডু (৪৮) বলেন, মৌসুমে (দুই মাস) এই হাটে গড়ে তিন থেকে চার হাজার মণ এবং বছরের অন্য নির্দিষ্ট সময়ে এক থেকে দেড় হাজার মণ পাট বেচাকেনা হয়। এ ছাড়া মৌসুমে হাটে দুই থেকে তিন হাজার মণ ধান এবং বছরের অন্য সময় ৫০০ থেকে এক হাজার মণ ধান বেচাকেনা হয়।

ধলগ্রাম বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ওসমান সরদার বলেন, ‘পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি এই হাটের কথা। ২০০ বছরের বেশি পুরোনো হবে এই হাট। একসময় এই হাটটি বিখ্যাত ছিল পাট ও ধানের জন্যে। আমরা দেখেছি ধলগ্রাম হাটের নদীর ঘাটে বড় বড় নৌকা থাকতো পাট ও ধান কেনার জন্য।’

ওসমান সরদার আরো বলেন, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে এখানে প্রায় ১০ একর জায়গায় দোকানপাট ও হাট বসে। হাটে প্রায় সাড়ে ৩০০ স্থায়ী দোকান রয়েছে। নদীর ঘাটটি ভেঙে গেছে। অনেক ব্যাপারী এখনো নৌপথ ব্যবহার করেন। তারা এখানে গোসলও করেন। ভেঙে যাওয়া ঘাটটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন করে তৈরি দরকার।

ধলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ধলগ্রামের হাটটি ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন। বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছি, তারা বহুকাল ধরে এই হাটে বেচাকেনা করেছেন। নদীর ঘাটটি ভেঙে গেছে। ঘাটটির সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

আমারবাঙলা/এমআরইউ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ই-সিগারেট উৎপাদন নিষিদ্ধের নির্দেশনায় সরকারের প্রতি বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোটের কৃতজ্ঞতা

দেশে ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ENDS) উৎপাদনের অনুমতি...

‘একজন শিল্পীকে ভীষণভাবে অসম্মানিত করা হচ্ছে’

দুই দশক আগে ‘হাজার বছর ধরে’ দিয়ে বড় পর্দায় অভিষেক। সিনেমায় নিজের...

রংপুরে হিন্দুপাড়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, জানাল প্রশাসন   

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগকে কেন্দ্র করে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি...

ব্যয়বহুল উন্নয়ন, পানিতে ভাসছে চট্টগ্রাম

১০ হাজার কোটি টাকা খরচের পরও চট্টগ্রাম নগর রক্ষা পেল না জলাবদ্ধতা থেকে। সোমবা...

আর্থিক সংকট, রাইফেল-পিস্তল লকারে, বন্ধ এসএ গেমসের ক্যাম্প

চার ইভেন্টের ২০ শুটার নিয়ে ১ জুলাই বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনে শুরু হয়েছ...

বুবলীর চমক,অন্য রকম জীবন

গানচিল মিউজিকের নতুন প্রজেক্ট ‘বাংলা অরিজিনালস’ শুরু হলো ‘ম...

মুহূর্তে বয়স কমে যায় মেয়েটার...

ফরিদা আক্তার পপি তাঁর আসল নাম। সত্তরের দশকের অন্যতম সেরা এই অভিনেত্রী আজ ৭১ ব...

এমবাপ্পেই রিয়ালের নতুন ‘১০ নম্বর’

কিলিয়ান এমবাপ্পে না আরদা গুলের-জার্সিটি উঠবে কার গায়ে? এ প্রশ্নের উত্তরের অপে...

উরুগুয়েকে উড়িয়ে কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিল

ছেলেদের ফুটবলে সময়টা ভালো না গেলেও মেয়েদের ফুটবলে দাপট ধরে রেখেছে ব্রাজিল। কু...

ডুবে গেছে রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু

টানা বৃষ্টি ও আর পাহাড়ি ঢলে কাপ্তাই হ্রদের পানি বাড়ায় ডুবে গেছে রাঙামাটির আইক...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা