চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে বাস্তহারা এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু হয় এক ব্যস্ততম কর্মযজ্ঞ—শুটকি শুকানোর মৌসুমী উৎসব। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন রোদে ঝলমলে সোনালী কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে কেউ। এই মাঠেই তৈরি হয় চট্টগ্রামের বিখ্যাত শুটকি, যা শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, রপ্তানিও হয় দেশের নানা প্রান্তে এমনকি বিদেশেও।
প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই নদীপাড়ে ভিড় জমায় শ্রমিকরা। কেউ মাছ পরিষ্কার করছে, কেউ লবণ মাখিয়ে বাঁশের চাটাইয়ে বিছিয়ে দিচ্ছে, আবার কেউ শুকিয়ে নেওয়া মাছ গুছিয়ে ঝুড়িতে ভরছে বিক্রির জন্য। পুরো এলাকা জুড়ে মাছ আর লবণের গন্ধে ভরে থাকে বাতাস। তবে এই গন্ধই জীবিকার উৎস হাজারো মানুষের।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. রফিকুল ইসলাম প্রায় ১৫ বছর ধরে শুটকি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি জানান, “আমরা মূলত কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত মাছ এখানে শুকাই। অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে শুটকি মৌসুম। এই সময় আবহাওয়া ভালো থাকে, রোদ বেশি থাকে—তাই মাছ দ্রুত শুকায়।” তিনি বলেন, “আমাদের এখানে রূপচাঁদা, লইট্টা, ছুরি, চেপা, কাতলা—বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকানো হয়। প্রতি মৌসুমে কয়েকশ’ টন শুটকি প্রস্তুত হয়, যার বেশিরভাগই যায় কক্সবাজার, সিলেট, এমনকি ঢাকাতেও।”
রফিকুলের মতে, এখন শুটকি ব্যবসা শুধু স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই, অনলাইনেও অর্ডার নেওয়া হয়। “মানুষ এখন স্বাস্থ্য সচেতন, তারা চায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে প্রস্তুত শুটকি। তাই আমরা এখন প্লাস্টিক শিটে মাছ শুকাই, যাতে ধুলো-ময়লা না লাগে,” বলেন তিনি।
শুধু ব্যবসায়ী নয়, এই শুটকি পল্লীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শত শত শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান। নারী শ্রমিকরাও সমানভাবে কাজ করছেন। নদীর পাড়ের এক নারী শ্রমিক রোকেয়া বেগম জানালেন, “আমরা সকাল ছ’টা থেকে কাজ শুরু করি। মাছ পরিষ্কার, ধোয়া, লবণ দেওয়া—সব করি হাতে। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি পাই। এই কাজেই সংসার চলে।”
তবে কাজটি যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, ততই কষ্টসাধ্য। রোকেয়া বলেন, “গন্ধে অনেক সময় মাথা ধরে যায়, হাতে লবণের কারণে চামড়া উঠে যায়। কিন্তু এই কাজ না করলে তো সংসার চলবে না।” তার মতো শত শত নারী পুরুষ প্রতিদিন এই মাঠেই ঘাম ঝরিয়ে জীবিকার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরেক শ্রমিক কামাল হোসেন বলেন, “আমরা শুটকি শুকানোর মাঠে কাজ করি মৌসুমভিত্তিক। বৃষ্টি শুরু হলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন অন্য কাজ খুঁজতে হয়। তবে এই সময়টায় আয় ভালো হয়।” তিনি জানান, শুটকি মাঠে কাজের পরিবেশ আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। আগে কাদামাটির মাঠে মাছ শুকানো হতো, এখন পাকা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে, যা স্বাস্থ্যকর ও টেকসই।
শুটকি ব্যবসায়ীরা জানান, ভালো আবহাওয়া ও মানসম্পন্ন মাছের যোগানই মূল চাবিকাঠি। কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগর থেকে আসা তাজা মাছ সরাসরি শুকানো হয় বলে এখানকার শুটকির স্বাদ আলাদা। এই কারণে দেশের নানা প্রান্তের ক্রেতারা চট্টগ্রামের শুটকির প্রতি বিশেষ আগ্রহী।
চট্টগ্রাম শহরের এক ক্রেতা নুরুন নবী বলেন, “বাস্তহারা এলাকার শুটকি অনেক ভালো মানের। আমি প্রতি বছর এখান থেকে লইট্টা আর চেপা শুটকি কিনি। এখন অনেক দোকানেই পাওয়া যায়, কিন্তু এখানকার স্বাদ অন্যরকম।”
তবে ব্যবসায়ীরা কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বললেন। তাদের মতে, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে এখন আগের মতো নিয়মিত রোদ পাওয়া যায় না, ফলে শুকানোর সময় বেড়ে যায়। এছাড়া নদীর দূষণও মাছের মানে প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী রফিকুল বলেন, “যদি সরকার থেকে শুকানোর জন্য আধুনিক ড্রায়ার মেশিন দেওয়া হয়, তাহলে আমরা সারা বছর শুটকি তৈরি করতে পারব। এতে বিদেশে রপ্তানিও বাড়বে।”
চট্টগ্রামের এই শুটকি পল্লী শুধু ব্যবসার ক্ষেত্র নয়, এটি এক প্রজন্মের পর প্রজন্মের জীবিকার ধারক। এখানে ঘাম ঝরায় জেলে, শ্রমিক, ব্যবসায়ী—সবাই মিলে তৈরি করেন চট্টগ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী রন্ধন উপাদান, যেটি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়ে চট্টগ্রামের নাম ছড়াচ্ছে দূরদূরান্তে।
কর্ণফুলীর হালকা বাতাসে যখন রোদে শুকানো মাছের গন্ধ ভেসে আসে, তখন সেই গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকে হাজারো মানুষের পরিশ্রম, স্বপ্ন আর টিকে থাকার গল্প। এই মাঠ শুধু শুটকি শুকানোর জায়গা নয়—এটি আসলে এক জীবন্ত শিল্প, যা চট্টগ্রামের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
আমারবাঙলা/এফএইচ