প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে নানা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় তারা। পোস্টাল ব্যালটে ভোটিং প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নিবন্ধন অ্যাপ তৈরি, ব্যালট মুদ্রণ এবং দেশের বাইরে ব্যালট-আনা নেওয়ার কাজ শেষ করতে এই সময়সীমা ধরা হয়েছে। বর্তমানে এ সংক্রান্ত প্রকল্প প্রণয়ন, বাজেট বরাদ্দ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট শাখা।
আগামী বছরের রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে ইসি। ভোটের তপশিল ঘোষণা হবে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। এই লক্ষ্যে সর্বাত্মক নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি।
এবার প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য প্রথমবারের মতো পোস্টাল ব্যালটে ভোট নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। তবে প্রবাসী ভোটারদের (ওসিভি) পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে (আইসিপিভি) সরকারি কর্মকর্তা ও নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি এবং জেলে বা আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রবাসীদের পোস্টাল ভোটিংয়ের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে অনলাইন নিবন্ধন ও ভোটদান পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে ইসি। এজন্য আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিংয়ের নানা কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
পোস্টাল ব্যালটে ভোটিংয়ের সম্ভাব্য ব্যয় নিয়েও পরিকল্পনা চলছে ইসিতে। এরই মধ্যে প্রবাসীদের ভোটদান পদ্ধতি উন্নয়নে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। যাতে ৪৯ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। আর ব্যালট আনা নেওয়ায় কত ব্যয় হতে পারে তা ভোটের আগে জানা যাবে। ইসির প্রাথমিক ধারণা, এতে কমপক্ষে ৪০০ কোটি ব্যয় হবে। তবে চাহিদা চূড়ান্ত হলে ব্যয় কমতে পারে।
ইসি সচিবালয়ের নির্বাচন পরিচালনা শাখা এবং বাজেট ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণ শাখার কর্মকর্তারা বলেছেন, ইসি থেকে খাতওয়ারি ব্যয় প্রাক্কলন করে দিলেই বরাদ্দের জন্য সরকারের কাছে দেওয়া হবে।
নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, আরপিওতে পোস্টাল ব্যালট ভোটিং যুক্ত করা হয়েছে। পোস্টাল ব্যালটে যারা ভোট দেবেন, তাদের ব্যালট হবে ‘সিম্বল ব্যালট’। যেখানে প্রার্থীর নামগুলো থাকবে না, কেবল নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত সব প্রতীক থাকবে। এই সিম্বল ব্যালট ভোটারের কাছে ভোটের তপশিল ঘোষণার আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
ব্যালট হাতে পাওয়ার পর তিনি অপেক্ষা করবেন প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত। প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত ও প্রতীক বরাদ্দ সম্পন্ন হলে তিনি পছন্দের প্রতীকে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দেবেন।
তিনি আরও বলেন, যারা অ্যাপের মাধ্যমে রেজিস্টার করেছেন অথবা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে দেখতে পাবেন যে, তার সংসদীয় আসনে কারা কারা চূড়ান্ত প্রার্থী এবং কার প্রতীক কোনটা। তারপর তিনি ব্যালটে ভোট দেবেন এবং ভোট দিয়ে সেটা ফেরত পাঠাবেন।
ভোটদান উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় ৪৯ কোটি টাকা
ইসি জানিয়েছে, পোস্টাল ব্যালটে প্রবাসীদের ভোটদানে ‘সিস্টেম উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন (ওসিভি-এসডিআই)’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৯ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন পেয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় অনলাইন নিবন্ধনে অ্যাপ তৈরিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, প্রবাসীদের ভোটদান নিশ্চিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। আর প্রবাসীদের ভোটিংয়ের ব্যালট আনা নেওয়া ও মুদ্রণসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে মাত্র আলোচনা শুরু হচ্ছে। সব মিলিয়ে কত ব্যয় হবে এমন ধারণা এখন দেওয়াও মুশকিল হবে।
নিবন্ধন শেষ হলে বাকি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন
নিবন্ধন শেষ হওয়ার পর প্রবাসী ভোটারদের ব্যালট আনা নেওয়ায় প্রক্রিয়া শুরু হবে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস ও সরকারি ডাক বিভাগের সঙ্গে আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত ডাক বিভাগের ওপরই আস্থা রেখেছে তারা।
এরই মধ্যে ডাক বিভাগ থেকে ইসির কাছে একটি প্রাথমিক প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। গত জুন মাসে এ সংক্রান্ত বৈঠকে ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইএমএস বা রেজিস্টার্ড সার্ভিসে একজন ভোটারের ব্যালট পেপার প্রবাসে পাঠানো এবং ফেরত আনতে ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা ব্যয় হতে পারে। এর বাইরেও ভোটারপ্রতি আরও ১০০ থেকে ২০০ টাকা খরচ হবে। ফলে প্রতি এক লাখ ভোটারের জন্য ছয় থেকে সাত কোটি টাকা লাগবে।
ইসির ধারণা, শেষ পর্যন্ত ভোটদানে আগ্রহী ৮-১০ লাখ প্রবাসীর সাড়া পাওয়া যাবে। ফলে এই কাজে কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে বলে প্রাথমিক ধারণা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, ডাকবিভাগ থেকে চূড়ান্ত চাহিদা এবং ইসির কারিগরি কমিটির চূড়ান্ত আলোচনার পর পোস্টাল ব্যালটের ব্যয় সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। এখনও অনেক সময় রয়েছে। তবে প্রাথমিক যে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে কম হতে পারে। এটা সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেহেতু হবে, সেহেতু কত সংখ্যক ভোটার নিবন্ধন করেন, তার ওপর ব্যয়বরাদ্দ নির্ভর করবে।
কবে কোন কাজ
রোজার আগে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের লক্ষ্যে কাজ করছে ইসি। ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল হতে পারে। আর জানুয়ারির মধ্যে প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানের প্রক্রিয়া শেষ করে রাখতে চায় ইসি।
ইসির পরিকল্পনা অনুযায়ী- আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মোবাইল অ্যাপ তৈরি, পরীক্ষামূলকভাবে প্রবাসী ও দেশের অভ্যন্তরের ভোটারদের নিবন্ধন, ট্রাকিং মডিউল এবং প্রতীক ও প্রার্থীদের সংযুক্ত করার কাজ শেষ করা হবে। ১ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবরের পর্যন্ত মোবাইল অ্যাপের ট্রায়াল, নিরীক্ষা, ত্রুটি সংশোধন ও ডেভলপমেন্টের জন্য প্রস্তুত করা হবে। ১ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বরে মধ্যে ব্যালট পেপার, নির্দেশিকা ও ঘোষণাপত্র মুদ্রণ করা হবে। আর ভোটার তালিকাভুক্তি নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হবে ১১ নভেম্বর থেকে, যা চলবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত।
এদিকে ডাকবিভাগ খামের কাস্টমাইজেশন করবে ১৫ নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি। ভোটারদের কাছে ব্যালট পেপার পাঠানো হবে ২০ নভেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। ভোটার তালিকা মুদ্রণ হবে ১ ডিসেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর।
এছাড়া নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হওয়ার পর প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দ হলে ভোটদানের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। ভোট প্রদান ও ব্যালট পেপার বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে। এরপর কমিশন প্রতিটি ব্যালট পেপার সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবে ফলাফল একীভূত হওয়ার আগে।
চলতি মাস থেকে শুরু হওয়া এসব নানা পদক্ষেপের পাশাপাশি পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানের প্রচারণা, উদ্বুদ্ধকরণ ও ভোটার শিক্ষা কার্যক্রমও চালাবে ইসি। যা চলবে ভোটগ্রহণের আগে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
প্রবাসীদের পোস্টালভোটিং সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও পরামর্শক সালিম আহমাদ খান জানান, প্রবাসী ভোটারদের ভোটদানের বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। মডিউল নিয়ে প্রচারণায় যাবেন তারা। প্রায় ১০ লাখ প্রবাসী ভোটারের ভোটদানের টার্গেট রয়েছে। ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। প্রযুক্তিগত বিষয়েগুলো চূড়ান্ত হলে ধাপে ধাপে সব কিছু জানানো হবে।
আমারবাঙলা/জিজি