পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের (ডানে) সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার | ছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সৌজন্যে
জাতীয়
কূটনৈতিক ব্যাকরণ

কেন হঠাৎ বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে পাকিস্তান?

আমার বাঙলা ডেস্ক

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দারসহ দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সফর সম্পর্কে ইসলামাবাদভিত্তিক সাংবাদিক আবিদ হুসাইন আল–জাজিরায় লিখেছেন। তিনি চেষ্টা করেছেন জানার, কেন পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে এত বেশি আগ্রহী।

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ২৩ আগস্ট সকালে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। এটি গত ১৩ বছরে পাকিস্তানের কোনো শীর্ষ কূটনীতিকের প্রথম ঢাকা সফর। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করাই তার সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।

অভ্যর্থনা গ্রহণের পর ইসহাক দার তার ঢাকা সফরকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং উল্লেখ করেন, এই সফর পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে এবং দুই দেশের অংশীদারিত্বকে নতুন উদ্দীপনা প্রদান করবে।

তিনি মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং গত এক বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।

ইসহাক দার ঢাকায় বলেন, ‘আমাদের এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যেখানে করাচি থেকে চট্টগ্রাম, কোয়েটা থেকে রাজশাহী, পেশোয়ার থেকে সিলেট এবং লাহোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত তরুণেরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একজোট হয়ে কাজ করবে এবং তাদের যৌথ স্বপ্ন পূরণ করবে।’

দুই দেশের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শহরের নাম উল্লেখ করে ইসহাক দার এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরকে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তাঁর সফরের আগে দুই দেশের কূটনৈতিক মহল ও সামরিক বিভাগে বেশ কিছু যৌথ কাজ হয়।

বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর দুই দেশের সম্পর্ক দ্রুত উষ্ণ হতে শুরু করে। শেখ হাসিনাকে ভারতের ঘনিষ্ঠ বলে ধরা হয়। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে দেশজুড়ে বিক্ষোভের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

কিন্তু চীনে নিয়োজিত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ খালিদ এখনো দুই দেশের সম্পর্কে বেশ কিছু জটিলতা রয়ে গেছে বলে মনে করেন। বিশেষ করে অতীত ইতিহাসের কারণে দুই দেশের আস্থায় ঘাটতি রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন তিনি।

খালিদ আল–জাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশের নতুন সরকার পাকিস্তানের পদক্ষেপের প্রতি ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পথে স্পষ্টত কিছু কৃত্রিম বাধা ছিল, যা এখন দূর করা হয়েছে।

মাসুদ খালিদ আরো বলেন, এখন গভীর সংলাপের জন্য একটি কাঠামো দরকার, যেখানে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে ভুল–বোঝাবুঝি দূর করা যেতে পারে।

সামরিক ও কূটনৈতিক সংলাপে জোর

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ গত বছর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দুবার বৈঠক করেছেন। তা সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্কে এত দ্রুত উন্নতি ঘটবে এবং উচ্চস্তরে নিয়মিত যোগাযোগ হবে, তা অনেক বিশ্লেষক আশা করেননি।

গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান ইসলামাবাদ সফর করেন এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে বৈঠক করেন। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ইসলামাবাদ সফর করেন। এর দুই মাস পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ ঢাকা সফর করেন।

ইসহাক দারের আরো আগে ঢাকা সফরের কথা ছিল। কিন্তু মে মাসে পাকিস্তান-ভারতের চার দিনের সংঘাতের কারণে তা স্থগিত করা হয়েছিল। তবে জুলাইয়ে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভি ঢাকায় সফর করেন।

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার দুই দিনের সফরে শনিবার দুপুরে ঢাকায় আসেন। ২৩ আগস্ট, ২০২৫ | ছবি: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে পাওয়া

আগস্টে ইসহাক দার এক দিনের বাংলাদেশ সফরে যান। অন্যদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহাম্মদ ফাইজুর রহমান পাকিস্তান সফর করেন। তিনি পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শমশাদ মির্জার সঙ্গে বৈঠক করেন।

ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার ক্ষেত্রে ইসলামাবাদ কৌশলগত কারণে ‘তাড়াহুড়া’ করছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন।

অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, হাসিনা সরকারের সময়ও পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছিল। এখন তারা ১৯৭৫ সাল–পরবর্তী সময়ের মতো দুই দেশের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ দেখছে। অধ্যাপক দেলোয়ার এখানে বাংলাদেশের স্থপতি ও হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড–পরবর্তী সময়ের কথা বলেছেন।

সেনাপ্রধান থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া জিয়াউর রহমানের আমলে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছিল। তিনি ১৯৭৫ সালের শেষ থেকে ১৯৮১ সালে আততায়ীদের হামলায় নিহত হওয়ার আগপর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন।

অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে শাসনক্ষমতা (রেজিম) পরিবর্তন ঐতিহাসিকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বন্ধুত্ব ও বৈরিতার দ্বৈতরথে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান সম্ভবত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বর্তমান উত্তেজনাও কাজে লাগাতে চাইছে। এটি একটি পরিচিত কূটনৈতিক কৌশল।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি দশকের পর দশক ধরে ঢাকার সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ককে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে আসছে। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার শিকড় ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে নিহিত।

পাকিস্তান ও ভারত ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবেই পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের সঙ্গে হলেও বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে আলাদা ছিল।

তখন ঘনবসতিপূর্ণ পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ, যাদের মধ্যে অনেকগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ছিল। ৪ কোটি ২০ লাখের বেশি জনসংখ্যা নিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, তথা বর্তমান বাংলাদেশ ছিল আরো বেশি ঘনবসতিপূর্ণ, যাদের অধিকাংশই বাংলাভাষী। তা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আধিপত্য চালাত। আর দুই পাকিস্তানের মাঝখানে ছিল ভারত।

বিভিন্ন কারণে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একপর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারত বাঙালিদের স্বাধীনতার সংগ্রামে সমর্থন দেয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের মিত্র কিছু মিলিশিয়া বাহিনী নৃশংসতা চালায়। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়।আনুমানিক দুই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হন।

ভারতের সামরিক সহায়তা নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়। তিনিই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি।

গত বছর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে প্রায় ১৬ বছর বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়া শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। গত বছরে আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।

পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ চৌধুরী বলেন, ভারতের ‘আঞ্চলিক আধিপত্যের’ বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ ও ঢাকার যৌথ অসন্তোষ রয়েছে। এ শরিকি অসন্তোষই তাদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

পাকিস্তানের সাবেক এই কূটনীতিক আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ভারতের আধিপত্যবাদের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। মে মাসের সংঘর্ষে পাকিস্তানে আমরাও তা প্রত্যক্ষ করেছি। এ পরিস্থিতিতে দুই দেশই দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যের বিষয়টি বুঝতে পারছে।’

মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আকাশপথে চার দিন তীব্র সংঘাত হয়েছিল। গত এপ্রিলে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাঁদের প্রায় সবাই পর্যটক। এ হামলার রেশ ধরেই মে মাসে পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে বসে ভারত। নয়াদিল্লির দাবি, পেহেলগামে হামলাকারীদের সহায়তা দিয়েছিল ইসলামাবাদ।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক শাহাব এনাম খান নয়াদিল্লির সঙ্গে ঢাকার বর্তমান সম্পর্ককে ‘কম উষ্ণ’ বলে বর্ণনা করেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হওয়ার কারণে তা আরো বেশি উষ্ণ হওয়ার কথা ছিল। তিনি মনে করেন, কোনো দেশের কূটনীতি মূলত অর্থনৈতিক প্রয়োজনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

শাহাব এনাম বলেন, ‘ভারতবিরোধী মনোভাবকে প্রায় সময় অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশকে কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শুধু নিরাপত্তা বা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাকে এড়িয়ে যেতে দেখা গেছে। এসবের চেয়ে দেশটি বরং অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগোতে পছন্দ করে।’

চীনের বাড়ন্ত প্রভাব

চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র বেইজিং শেখ হাসিনার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। হাসিনা ভারত ও চীনের মধ্যে বন্ধুত্বকে সমন্বয় করতে সক্ষম হলেও এশিয়ার এই দুই শক্তি সাধারণত পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পরও বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উপস্থিতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে চীন। গত মার্চে মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিং সফর করেছেন। এরপর আগস্টে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকের-উজ-জামান এক সপ্তাহের জন্য চীনের সফরে যান।

এই অধ্যাপক আরো বলেন, বাংলাদেশ তার আকাশে (লড়াইয়ের) সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে চীনের তৈরি ১২টি জে-১০সি যুদ্ধবিমান কেনার কথা ভাবছে।

অধ্যাপক দেলোয়ার এখানে যে জঙ্গি বিমানের প্রসঙ্গ টেনেছেন, তা পাকিস্তানের কাছেও রয়েছে। ভারতের সঙ্গে মে মাসের সংঘাতে এসব বিমান ব্যবহার করা হয়েছিল। চীন এসবের পাশাপাশি পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্র। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ঋণ, বিনিয়োগ ও সামরিক সরঞ্জামের গুরুত্বপূর্ণ উৎসও চীন।

অধ্যাপক হোসেনের মতে, এসব ঘটনা ঢাকা ও ইসলামাবাদকে আরো কাছে নিয়ে আসছে এবং তাদের সম্পর্ককে একটি শক্তিশালী অংশীদারত্বে রূপান্তরিত করছে।

ঢাকায় বিভিন্ন বৈঠক

বাংলাদেশে দুই দিনের সফরে ইসহাক দার অনেকগুলো বৈঠক করেছেন। মুহাম্মদ ইউনূস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
সেই সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী (জেআই) এবং শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন দার।

বাংলাদেশে ২০২৬ সালের শুরুর দিকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব বৈঠক বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ভারতে নিয়োজিত পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার আবদুল বাসিত। তিনি বলেন, ‘ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যা–ই ঘটুক না কেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। অতীতের নিয়ে আমাদের কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করা সম্ভব এবং তা বাধা হয়ে থাকা উচিত নয়।’

চীনে নিয়োজিত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত খালিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেলোয়ারের মতে, শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে দুই দেশই উপকৃত হবে।

২০২১ সাল থেকে প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ ধরে রেখেছে বাংলাদেশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি পিছিয়ে রয়েছে। গত বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বর্তমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তেমন একটি বড় নয়। কিন্তু তা ক্রমে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে। পাকিস্তান ২০২৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬ কোটি ১০ লাখ (৬৬১ মিলিয়ন) ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানে মাত্র ৫ কোটি ৭ লাখ (৫৭ মিলিয়ন) ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে।

অধ্যাপক দেলোয়ারের মতে, যদি দুই দেশ বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে, তাহলে উভয় দেশ পরস্পরের কাছ থেকে সুবিধা নিতে পারবে। কাঁচামালের উৎস এবং সম্ভাব্য বাজার—উভয় দিক থেকে তাদের এ সম্ভাবনা রয়েছে।

অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, পাকিস্তান থেকে তুলা ও বস্ত্রজাত পণ্য, চাল, সিমেন্ট, ফল এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য আমদানি করে উপকৃত হতে পারে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান পাট ও পাটজাত পণ্য, হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড বা জীবাণুনাশক তরল, রাসায়নিক এবং তামাকজাত পণ্য আমদানি করতে পারে।

এই অধ্যাপক বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ৪৩ কোটি, যা পশ্চিম ইউরোপের জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি।

ঐতিহাসিক ক্ষোভ এখনো বিদ্যমান

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সম্পর্কের সবচেয়ে গভীর ফাটল এখন পর্যন্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। ঢাকার পক্ষ থেকে এখনো সে হত্যাযজ্ঞের জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমার দাবি অব্যাহত রয়েছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশে বসবাসকারী দুই লাখের বেশি উর্দুভাষী মুসলিমের (নাগরিক) মর্যাদা নিয়েও বিরোধ রয়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর এই উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী মানুষের অধিকাংশই বর্তমান ভারতের বিহার থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) গিয়েছিলেন।

কারণ, পূর্ব পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় বিহারের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ১৯৭১ সালে গঠিত বাংলাদেশ উর্দুভাষী মুসলিমদের অধিকার সীমিত করেছে। তাঁদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে ইসলামাবাদেরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে।

এ ছাড়া অবিভক্ত পাকিস্তান (১৯৭১ সালের আগের) থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সম্পদের হিস্যা চায় বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে দেওয়া প্রতিশ্রুত অনুদান হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছে দেশটি।
সেই ঘূর্ণিঝড়ে আনুমানিক তিন লাখ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। এ বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সরকারের পদক্ষেপ ছিল ধীর ও প্রায় অপর্যাপ্ত। অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণ মূল উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছে।

পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব আইজাজ চৌধুরী মনে করেন, (এসব বৈষম্যমূলক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও) উভয় দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন রয়েছে।

এই সাবেক কূটনীতিক বলেন, ‘পাকিস্তানের জনগণও ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মতোই ব্যথিত। আমি মনে করি, এ ব্যথা সাধারণ এবং উভয় দেশের মানুষ এখন এগিয়ে যেতে চান।’

তবে অধ্যাপক দেলোয়ার মনে করেন, বর্তমান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক মজবুত করার প্রতি দৃঢ় সমর্থন রয়েছে। তা সত্ত্বেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত বিষয়গুলো এখনো (দুই দেশের) সম্পর্ক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে আছে।

এই অধ্যাপক বলেন, ‘এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পরও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনমানসিকতায় মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাঁদের প্রত্যাশা, দায় স্বীকার করে অতীতের ক্ষত সারিয়ে তুলতে পাকিস্তান পদক্ষেপ গ্রহণ করুক।

এসব কিছু সত্ত্বেও ঢাকা অতীতে আটকে থাকতে চায় না বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক দেলোয়ার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, কূটনীতি একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। উভয় দেশ অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি তারা অতীতের ক্ষত সারানোর প্রক্রিয়াও অব্যাহত রাখতে পারবে।

আমারবাঙলা/এফএইচ

Copyright © Amarbangla
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে ৩৬ প্রস্তাব বিএনপির

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে...

বাংলাদেশে সাইবার হামলার বড় অংশ আসে চীন থেকে

দেশের ব্যাংক খাতে প্রতিদিনই চার শতাধিক সাইবার হামলার শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদে...

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের রায়ের দিন ঘোষণা হবে ১৩ নভেম্বর

গত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষম...

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি চায় অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক

যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ নাগরিক মনে করেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া...

আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রীর ছেলে

কিশোরগঞ্জ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্বাস্থ্যপ্রতিম...

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের রায়ের দিন ঘোষণা হবে ১৩ নভেম্বর

গত জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষম...

নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে ৩৬ প্রস্তাব বিএনপির

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে...

একটি দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার সুযোগ খুঁজছে: সালাহউদ্দিন

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ মন্তব্য করেছেন, একটি রাজনৈতিক দল...

আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রীর ছেলে

কিশোরগঞ্জ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও তৎকালীন বিএনপি সরকারের স্বাস্থ্যপ্রতিম...

বাংলাদেশে সাইবার হামলার বড় অংশ আসে চীন থেকে

দেশের ব্যাংক খাতে প্রতিদিনই চার শতাধিক সাইবার হামলার শিকার হতে হচ্ছে। বাংলাদে...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
খেলা