বাকী বিল্লাহ ফাহাদ: ১৩৫৮ সনের ৮ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার ছিল বাঙ্গালি জাতিসত্বার নব উত্থানের যুগ সন্ধিক্ষণের সময়। এই দিনে আমরা আমাদের মায়ের মুখের ভাষার জন্য জীবন দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি, আমরা আমাদের ভাষার জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে পারি।
সে দিন অপরাহ্ণ ৩টা, ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের ইউক্যালিপটাস শোভিত প্রশস্ত রাজপথ ধরে ছোট ছোট দলে সামনে আগাচ্ছিল। হঠাৎ কোনো ধরনের সতর্ক বার্তা ছাড়াই পুলিশ আক্রমণ করে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের উপর।
এতে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিকউদ্দিন হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিহত হন। পুলিশের গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে যায়। আর তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান মায়ের মুখের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
২০নং ব্যারাকের বারান্দায় শামসুল বারী ওরফে মিয়া মোহনকে দেখে এগিয়ে আসার সময় আবুল বরকতকে ধরাশায়ী করে পুলিশের গুলি। তিনি রাত ৮ টায় ঢাকা মেডিকেলে মারা যান।
কিছুক্ষণ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র আবুল বরকতের তলপেট আর উরু গুলিবিদ্ধ করে পুলিশ। অপারেশন থিয়েটার থেকে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
১৪৪ ধারার আগুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠা হায়েনা পুলিশ ১১ বছরের একজন শিশুকে পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ করে। এভাবেই শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ ১৪ জন। আহত হন আরও অনেকে।
কিন্তু আমরা এই ৮ই ফাল্গুনে মহান শহীদদের আত্মত্যাগের উদ্দেশ্যকে কতটুকু সফল করতে সক্ষম হয়েছি? আমরা কি আসলেই তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পেরেছি?
ভাষা আন্দোলনের মর্মবাণী ছিল এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছরের মধ্যে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে এটি পালিত হয়ে আসছে জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে।
কিন্তু ভাষা শহীদদের প্রধান যে অঙ্গীকার- সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন, সেটি আমরা করতে পারিনি স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও। দেশে প্রায় ২৫ শতাংশের মতো মানুষ এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘‘কোনো শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে চাইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়৷’’
আমরা মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করতে পারিনি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলা চালু থাকলেও বাংলা এখনো হয়নি উচ্চশিক্ষার বাহন।
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত আদালতে রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। বিচারকদের উচ্চ আদালতের বেঞ্চের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভাষার মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে তারা রায় বাংলায় লিখে তাও আবার সফটওয়্যার দিয়ে ট্রান্সলেশন করা হয়। বাকী ১১ মাস ইংরেজিতেই লেখেন!
বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রকৌশলসহ বহু বিষয়ে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা করা সম্ভব হয়নি আমাদের। ফলে এসব বিষয়ে শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে পড়তে বাধ্য হচ্ছে।
অথচ জাপান, জার্মানি, তুরস্ক, সুইজারল্যাড ফ্রান্স, কোরিয়াসহ বহু দেশ তাদের মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার সব দ্বার খুলে দিয়েছে, যাদের লোকসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।
তারা নিজের ভাষায় জ্ঞানচর্চা করে বিশ্বে নিজেদের অবস্থান নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। তারা এখন আবির্ভূত হয়েছে বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে। অথচ আমরা স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসেও আমাদের নিজস্ব ভাষায় প্রকৌশল বা চিকিৎসাশাস্ত্রের উপর একটা পুস্তক রচনা করতে সক্ষম হইনি।
আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সাইনবোর্ড, ব্যানার, নাম ইত্যাদিতে ইংরেজি ব্যবহার করে আসছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের নেই কোনো ধরনের পদক্ষেপ। আমাদের দেশের পণ্যের গায়ের ব্যবহারবিধি দেয়া হয় ইংরেজিতে।
অথচ আমরা বাঙালি জাতিসত্ত্বা নিয়ে গর্ব করি। আমাদের দেশে এখন বাংলা মিডিয়ামের তুলনায় ইংরেজি মিডিয়াম, ইংরেজি ভার্শনের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা বাংলা না পারাটাকে এখন আধুনিকতা মনে করছে।
অথচ আমাদের এই ভাষার জন্যই রাজপথে জীবন দিয়েছিল তার মত শিক্ষার্থীরা। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা জানে না একুশে ফেব্রুয়ারির বাংলা তারিখ কত। অনেকে তো কেন পালন করা একুশে ফেব্রুয়ারি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে নাকানিচুবানি খেয়ে বসে।
ভাষার মাস আসলে আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহারের সব তৎপরতা শুরু হয়। সারা বছর আমরা এ বিষয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপের ধার ধরি না। বাংলা ভাষাকে পুনর্জীবিত রাখতে যে দুটো প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছে, তাদের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।
১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাংলা একাডেমির সারা বছরের কার্যক্রম হলো মাঝে মাঝে দু-চারটা বাংলা বানান পরিবর্তন করা আর আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটের তো কোনো কাজ আছে বলে মনে হয় না। রাজপথে রক্ত আর জীবন দিয়ে অর্জন করা ভাষার এই অবস্থা দেখাটা আসলেই লজ্জাজনক।
আমাদের ভাষাকে আমরা যদি বাঁচিয়ে রাখতে পদক্ষেপ না গ্রহণ করি, তাহলে একদিন এই ভাষা হুমকির মুখে পড়বে। আমাদের উচিৎ দেশের সর্বস্তরে আইন করে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা।
আমলাদের সকল কার্যক্রমে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা। বাংলা ভাষা শেখার প্রতি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা। তাহলে আমাদের ভাষা শহীদদের ৮ ফাল্গুনের রাজপথে আত্মত্যাগ স্বার্থক হবে।
লেখক: বাকী বিল্লাহ ফাহাদ (শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
এবি/এইচএন
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            