এম এম রুহুল আমীন: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তান বাহিনী মুক্ত ঢাকায় লাখো মানুষের আকাশ ফাটানো জয় বাংলা ধ্বনির মধ্যে আত্মসমর্পণ করে। ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা কলকাতা থেকে ঢাকায় ফেরে। শত্রুমুক্ত ঢাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা এসে পৌঁছালে হাজার হাজার মানুষ তাদের বীরোচিত সংবর্ধনা জানায়। মুজিবনগর মন্ত্রিসভার ঢাকা আগমনের মধ্য দিয়ে ঢাকা রাজধানী হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধীতাকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্ত দূতাবাস থেকে ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে তাদের সরকারের কাছে দুটি সুপারিশ পাঠায়। একটি বাংলাদেশ সরকারকে মেনে নেওয়া এবং অপরটি অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করা। এরপর শুরু হয় মহাবীরের আগমনের প্রতীক্ষা।
৮ জানুয়ারি ১৯৭২। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ভোর ৩ টায় হিথ্রোর উদ্দেশ্যে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিদায় সংবর্ধনা জানান। পাকিস্তান ছাড়ার আগে বঙ্গবন্ধু ও কামাল হোসেনকে জানানো হয়েছিল ফ্লাইট যখন লন্ডনের কাছাকাছি পৌঁছাবে বা দু-এক ঘন্টার দূরত্বে থাকবে তখনই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। ফ্লাইটে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান আছেন। হিথরো পৌঁছা মাত্র তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ভিআইপি এরিয়ার দিকে। ভিড় ঠেলে বঙ্গবন্ধু যখন সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন একটি ঘোষণা এলো এখানে শেখ মুজিব আছেন? শেখ মুজিবুর রহমান? কেউ কি দেখবেন তিনি এখানে আছেন কিনা? তাঁর একটি ফোন কল এসেছে। ফোনের অপরপ্রান্তে ছিলেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের ইয়ান সাদারল্যান্ড। সাদারল্যান্ডের প্রশ্ন ছিল শেখ মুজিব কি সত্যিই এসেছেন? এটি সত্যিই একটি স্বস্তির খবর। আমি ৪০ মিনিটের মধ্যে বিমানবন্দরে পৌঁছাব। ব্রিটিশ সরকার শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান হিসেবে স্বাগত জানাবে এবং পূর্ণ প্রটোকল অনুসরণ করবে।
পাকিস্তানের চার্টার্ড বিমানে করে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখ লন্ডনে পৌঁছান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান এবং রাতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে এক ঘণ্টার বৈঠকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাজ্য কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি উত্থাপন করেন। লন্ডনে ২৪ ঘন্টা অবস্থানের পর ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের জেটে করে সাইপ্রাস-ওমান হয়ে ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে দিল্লিতে যাত্রা বিরতি করেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডন -দিল্লী হয়ে প্রাণের শহর ঢাকায় ফিরে আসেন দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে।
ঢাকায় অবতরণের আগে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহের প্রতি শ্রদ্ধাবশত প্রায় ৪৫ মিনিট ব্রিটিশ এয়ার ফোর্সের জেটটি বিমানবন্দরের ওপরে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। বঙ্গবন্ধু মন ভরে তাঁর প্রাণের শহর ঢাকাকে দেখে নেন। বিমানবন্দর থেকে লাখো জনতার ভিড় ঠেলে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লাগলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছাতে। রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মত কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। ৩৫ মিনিটের ভাষণে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বললেন আমি জানতাম না, আমি আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারবো। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙ্গালিদের কাছে ফিরিয়ে দিও। আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, মানুষ একবারই মরে... মরার আগে বলে যাব আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা...।
বঙ্গবন্ধু আরো বলেন ৭ মার্চ আমি এই রেসকোর্সে বলেছিলাম "দুর্গ গড়ে তোলো"। আজ আবার বলছি আপনারা একতা বজায় রাখুন। আমি বলেছিলাম বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। বাংলাদেশ আজ মুক্ত স্বাধীন। আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
জনসভা শেষে ধানমন্ডির বাড়িতে পৌঁছালে এক আবেগঘন পুনর্মিলনের দৃশ্য দেখা যায়। সকাল থেকেই ভিন্ন মেজাজে ছিল ওই বাড়ির সবাই। বাড়িতে কোন টেলিভিশন ছিল না। বেতার ধারা বিবরণীতে বিমানের নিরাপদ অবতরণের খবর প্রকাশের পর বেগম মুজিব একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন...। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় স্বাধীন বাংলার পতাকাবাহি একটি সাদা ক্যাডিলাক গাড়ি প্রবেশ করল এ বাড়ীর প্রবেশ দ্বারে, গাড়ির দ্বার খুলে একে একে বেরিয়ে এলেন স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব...। বন্ধু বান্ধবরা যখন তার উপর ফুলের পাপড়ি বর্ষনে ব্যস্ত তখন তিনি তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেন। এরপর তিনি তার ৯০ বছর বয়স্ক পিতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসেন এবং তাঁকে কদমবুচি করেন। আর ৮০ বছর বয়স্কা মা এসে ঘরে ঢুকলে তিনি তাঁকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।
এবি/এইচএন
 
                                    
                                 
                 
                     
                     
                         
                                                     
                         
                                                     
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                         
                        
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                     
                             
                             
                     
                         
                                 
                                 
                                 
                                 
             
                     
                             
                             
                            